২০৪১ সালের মধ্যে শিল্পে সারা দেশে গ্যাস

একসময় ঢাকা সিটি, চট্টগ্রাম সিটি, সিলেট সিটি ও ময়মনসিংহের আংশিক এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল গ্যাস নেটওয়ার্ক। একসময় গ্যাস বলতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটির বিষয় মনে করা হতো। বর্তমানে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি সঞ্চালনের আওতা বাড়াতেও অনেক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। শিল্পায়নের প্রধান নিয়ামক এই শক্তিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ দ্রুতই এগিয়ে চলছে বলে জানা গেছে।

বর্তমান সরকার দেশের সুষম উন্নয়নের জন্য সারা দেশের গ্যাস নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচিকে সর্বাত্মক সফল করতে এর বিকল্প দেখছেন না বিনিয়োগকারীরা। সে লক্ষ্যেই সম্প্রসারণ করা হচ্ছে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হয়ে বগুড়ায় যাওয়া পাইপলাইন এখন ১৩৯ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী শহর ছুঁয়ে ফেলেছে। পৃথক একটি লাইন ভেড়ামারা থেকে খুলনায় গিয়ে শহরকে যুক্ত করেছে। ২০ ইঞ্চি ব্যাসের এই পাইপলাইনটির কাজ অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে।

কয়েক বছর আগে সিরাজগঞ্জ হয়ে বগুড়ায় গ্যাস সরবরাহ শুরু হলেও স্বল্পচাপ ছিল নিত্যদিনের চিত্র। দিনের বেশির ভাগ সময় জ্বলত না চুলা। ফিলিং স্টেশনগুলো পড়ে থাকত বেকার। সেই স্বল্প চাপ নিরসনে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিবিয়ানা থেকে ধনুয়া পর্যন্ত ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৩৬ কিলোমিটার বিকল্প সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পটির কিছু অংশ বন বিভাগের সঙ্গে জটিলতার কারণে থমকে ছিল। শিগগিরই কাজ শেষ হলে চাপ ও সরবরাহ দুটিই বাড়বে বলে মনে করছে জিটিসিএল। এ ছাড়া স্বল্পচাপ দূর করার জন্য এলেঙ্গাতে তিনটি কম্প্রেসর স্থাপন করায় পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটা উন্নত হয়েছে।

একইভাবে নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের স্বল্পচাপ দূর করতে আশুগঞ্জ হতে বাখরাবাদ হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে ১২১ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুমোদিত হয়। এক হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার এই প্রকল্পটির কাজ চলতি জুনেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের আওতায় (বগুড়া থেকে রংপুর হয়ে সৈয়দপুর) ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৫০ কিলোমিটার সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। এর সঙ্গে থাকছে ১০০ এমএমএসসিএফডি সিজিএস (সিটি গেট স্টেশন)। রংপুর ও পীরগঞ্জে যথাক্রমে ৩০ ও ২০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন টিবিএস (টাউন বর্ডার স্টেশন) স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নীলফামারী ইকোনমিক জোনে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের শিল্পায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সরকার দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা ও বরিশাল বিভাগে জালের মতো নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ভবিষ্যৎ এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা (ভোমরা)-খুলনা (আড়ংঘাটা) ৩০ ইঞ্চি ব্যাস ৬৫ কিলোমিটার, লাঙ্গলবন্দ-মাওয়া এবং জাজিরা টেকেরহাট ৭৫ কিলোমিটার (৩০ ইঞ্চি ব্যাস), খুলনা-গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট ৭৭ কিলোমিটার (৩০ ইঞ্চি), টেকেরহাট-ফরিদপুর এবং টেকেরহাট-বরিশাল ১১৫ কিলোমিটার (৩০ ইঞ্চি), ভোলা-বরিশাল ৬০ কিলোমিটার (৩০ ইঞ্চি), পায়রা-বরিশাল ৮৭ কিলোমিটার (৪২ ইঞ্চি), খুলনা-বাগেরহাট-পিরোজপুর-ঝালকাঠি-বরিশাল ১১০ কিলোমিটার (৩৬ ইঞ্চি) এবং হাটিকুমরুল বগুড়া ৫৫ কিলোমিটার (৩০ ইঞ্চি) সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে অঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহ যত আগে নিশ্চিত হয়েছে সেই অঞ্চল তত এগিয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলে বগুড়ার পর গ্যাস সরবরাহ নেই; যে কারণে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের ১০ জেলায় শিল্পের প্রসার নেই বললেই চলে। কয়েকটি সুগারমিলস ছাড়া ভারী শিল্প বলতে গেলে কিছুই নেই। একই অবস্থা বরিশাল বিভাগেও। শিল্প-কারখানা না থাকায় এসব এলাকার লোকজনের ঢাকামুখী প্রবণতা লক্ষণীয়। কর্মসংস্থানের অভাবে একসময় কার্তিক মাস এলেই মঙ্গা দেখা দিত উত্তরাঞ্চলে। বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগে মঙ্গা এখন বিতাড়িত হলেও মানুষের মধ্যে সেই স্বাচ্ছন্দ্য এখনো ফেরেনি। উদ্যোক্তারা মনে করেন, গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। গ্যাস না থাকা অঞ্চলে শিল্পায়নে কেউ এগিয়ে আসছেন না। এতে করে বিশাল অর্থনৈতিকবৈষম্য তৈরি হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ পেলে অনেক উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসবেন। চাপ কমে আসবে রাজধানী ঢাকার ওপর।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, শুধু বিশেষ এলাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন নয়, প্রধানমন্ত্রী চান সারা দেশের সুষম উন্নয়ন। দেশে ১০০ বিশেষ ইকোনমিক জোন স্থাপিত হচ্ছে তারই অংশ হিসেবে। এসব ইকোনমিক জোনে গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ইতিবাচক নির্দেশনা রয়েছে। যে কারণে সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গ্যাস নেটওয়ার্কের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

জিটিসিএল এমডি প্রকৌশলী রুখসানা নাজমা ইছহাক বলেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের সুষম বণ্টন ও সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করা। সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা। সে কারণে সারা দেশে গ্যাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অনেক অগ্রগতি দেখতে পাবেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বড় বড় শহরগুলোতে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা রয়েছে।

অতীতের সরকারগুলোর দূরদর্শিতার অভাবে গ্যাস সেক্টর নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি সরবরাহ। বলা হয় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এখনো তিমিরেই রয়ে গেছে। পাশের দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। সে কারণে ঘাটতি মোকাবেলায় বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। সেই আমদানি নিরবচ্ছিন্ন রাখতে মহেশখালী থেকে আনোয়ারা হয়ে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ১২১ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করেছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।

বিভিন্ন কম্পানির ৫৪২.৩৭ কিলোমিটার সঞ্চালন পাইপ এবং ১৭৫ কিলোমিটার কনডেনসেট সঞ্চালন লাইন নিয়ে ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। কম্পানিটির বর্তমানে পাইপ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য এক হাজার ৯৫০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। কনডেনশেড সঞ্চালন পাইপলাইন ১৯৩ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে।

 

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ