সতর্ক বাংলাদেশের চোখ জয়ে

বায়োস্কোপের জামানা এখন সুদূর অতীত। ‘জেনারেশন এক্স’ পর্দা সরিয়ে কাঠের বাক্সের ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে রঙিন ছবি দেখার রোমাঞ্চের খবরই হয়তো জানে না। আধুনিকতার রেসে এগিয়ে থাকা নিউজিল্যান্ডারদের বায়োস্কোপের অভিজ্ঞতা অবশ্য গতকাল হয়েছে। মিরপুরের ম্যাচ উইকেটের কাভার তুলে সফরকারীদের দলে দলে পুরো স্কোয়াডের উঁকিঝুঁকি মারার সঙ্গে ফিকে হয়ে যাওয়া বায়োস্কোপের বেশ যায়।

কী দেখলেন, বুঝলেন—তাঁরাই জানেন। তবে এই মাঠে খেলে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহও যখন উইকেটের পূর্বাভাসে শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তখন ধরে নেওয়া যায় মিরপুরের উইকেট কিউইদের সিলেবাসের বাইরেই আছে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ চাক্ষুষ করার পর বলেও দেওয়া যায় মাহমুদ উল্লাহর দলের জন্য ক্রাইস্টচার্চের বাউন্সি উইকেট যতটা বিপজ্জনক, মিরপুর সম্ভবত তার চেয়েও দুর্বোধ্য টম ল্যাথামদের জন্য। এ বছরের এপ্রিলেই অকল্যান্ডে দশম ওভারে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আবার সেই বাংলাদেশই গত মাসে মিরপুরে মাত্র ৬২ রানে উড়িয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে। বলার অপেক্ষা রাখে না ম্যাথু ওয়েডের দলের তুলনায় শক্তিতে পিছিয়ে এই নিউজিল্যান্ড। তাতে সিরিজটি ৫-০ হওয়ারই কথা। অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষে।

মাহমুদ উল্লাহ অবশ্য এজাতীয় আলোচনাকে ডালপালা মেলতে দেননি, ‘টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা এমন যে আপনি নিজেকে ফেভারিট ভাবতে পারেন। তবে যদি অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে যান তাহলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। নিউজিল্যান্ডও ভালো দল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ওরা খুব ডিসিপ্লিনড একটা দল।’

বাংলাদেশ দলে এমনিতেই নেতিবাচক প্রভাবের নানা উপসর্গ বিদ্যমান। মুশফিকুর রহিম ও নুরুল হাসানকে উইকেটকিপিং ‘লড়াইয়ে’ নামিয়ে দিয়ে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো যে অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন—সেরকম ইঙ্গিত রয়েছে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ফেসবুক স্ট্যাটাসে। যথারীতি প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছে মাহমুদের সামনে। বোধগম্য কারণেই সিরিজ শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে তিনি কৌশলে বিতর্ক এড়িয়ে গেছেন, ‘মুশফিক দারুণ টিমমেট। ও খুশিমনেই (নুরুল হাসান) সোহানের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। সোহান কিপিংয়ে দুর্দান্ত, মুশফিকও অসাধারণ।’ এ থেকে কে কী বুঝলেন, সে দায় তাঁর!

অবশ্য মাহমুদ অধিনায়ক, একে ওর চেয়ে এগিয়ে রাখার কথা প্রকাশ্যে বলা শোভন নয়। বরং ১৯ জনের স্কোয়াডের প্রায় সবার সামর্থ্যের পক্ষে যেসব বিশেষণ ব্যবহার করেছেন, তাতে তাঁর একাদশ দাঁড় করানোই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠার কথা। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ওপেনিং নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছিল। তাই কদিন আগে ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্সের ওপেনিংয়ে দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথায় চমক ছিল। গতকাল মাহমুদের কণ্ঠেও চারজন দক্ষ ওপেনারের কথা শোনা গেল, ‘লিটন অসাধারণ ওপেনার। সৌম্য এ বছর দারুণ ফর্মে আছে। নাঈম আমাদের শীর্ষ ওপেনারদের একজন। শেখ মেহেদীও ওপেনিংয়ের ভালো বিকল্প।’ এত এত বিকল্প থাকায় ইনিংসের শুরু নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘এগুলো নিয়ে আমার খুব একটা চিন্তা নেই। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যারা সুযোগ পায় তারা যেন দলের জন্য অবদান রাখে। আমরা যেন ইতিবাচক মানসিকতা দেখাতে পারি।’

নিউজিল্যান্ডে চুরমার হয়ে আসা বাংলাদেশ মনোবল চাঙ্গা হওয়ার টনিক পেয়েছে সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়ে সিরিজে। নিউজিল্যান্ডে ফর্মহীনতায় খাবি খাওয়া দল থেকেই আট টি-টোয়েন্টির পর পড়েছে মধুর সমস্যায়, সেটা কাকে রেখে কাকে খেলানোর! মাহমুদ তাঁর টিমমেটদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে সর্বোচ্চ বিশেষণ জুড়ে দিয়েছেন। অবশ্য দলকে চাঙ্গা রাখার জন্য অধিনায়ককে বিশেষণ ব্যবহারে খুব হিসেবি হলে চলেও না। টিম মিটিংয়ে একাদশ গঠনের সময় সবাইকে সবার ভূমিকা বুঝিয়ে দিলেই হলো। লিটনের সঙ্গে সৌম্য নাকি নাঈম—ওপেনিং জুটির ফায়সালাও হবে সেখানে। সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত তো নেওয়া হয়ে গেছে। মুশফিক নন, আজ উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় দেখা যাবে নুরুল হাসানকে। তবে সত্যিকারের ‘মধুর সমস্যা’ বোলিং কম্বিনেশন নিয়ে। টানা দুই সিরিজে পেসার-স্পিনারদের সবাই পারফরম করেছেন। হোম কন্ডিশনে স্পিনভারী একাদশ গড়লে বিসর্জন দিতে হবে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন কিংবা শরিফুল ইসলামের মধ্য থেকে একজনকে। অবশ্য শেখ মেহেদীকে ‘মেকশিফট ওপেনার’ ভূমিকায় খেলালে তিন পেসার নিয়ে নামতেও বাধা নেই বাংলাদেশের। এই ফরম্যাটে অলরাউন্ডারদের চাহিদাই তো বেশি।

তুলনায় নিউজিল্যান্ড স্কোয়াডটা ছোট—১৬ জনের। এঁদের একজন, ফিন অ্যালেন আবার কডিভ পজিটিভ। গতকাল ও আজকের দুটি পরীক্ষায় নেগেটিভ হলে পরে আইসোলেশন থেকে বের হতে পারবেন অকল্যান্ডে বাংলাদেশকে তুলাধোনা করা এই টপ অর্ডার। তবে বিষয়টি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন নন নিউজিল্যান্ডের হয়ে আজই প্রথম কোনো টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব করতে নামা টম ল্যাথাম। তিনি আস্থা রাখছেন দলের অলরাউন্ডারদের ওপর।

সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের জন্য যুগে যুগে ভূরি ভূরি মিনি অলরাউন্ডার বিশ্বকে দেখিয়েছে কিউইরা। ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির সবাইকে ছাড়া বাংলাদেশে আসা নিউজিল্যান্ড দলেও অলরাউন্ডারের ছড়াছড়ি। উপমহাদেশের কন্ডিশন উপযোগী তিন স্পিনারের কথা বলেছেন ল্যাথাম, যাঁদের দুজন—রাচিন রবীন্দ্র ও কোল ম্যাককনি মূলত ব্যাটিং অলরাউন্ডার। একমাত্র বিশেষজ্ঞ স্পিনার এজাজ প্যাটেল। তবে কিউইদের সমস্যা হলো তাদের বোলিং আক্রমণ পেসনির্ভর। গতির কারণে নিজ দেশে নাম কুড়ানো বেন সিয়ার্সও মনে করছেন, মিরপুরে যত গতি তত মার জুটবে ভাগ্যে। তাই অস্ট্রেলিয়ার সিরিজের ভিডিও দেখে গতিবৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর দীক্ষা নিয়েছেন সিয়ার্স অ্যান্ড কোং। এঁদের শিরোমণি কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম, যিনি বিগ হিটিংয়েও সিদ্ধহস্ত।

বাংলাদেশের শঙ্কার জায়গাটা এখানেই। পাওয়ার হিটিংয়ে জেনেটিক্যালি কয়েক ধাপ এগিয়ে কিউইরা। কিন্তু মিরপুরের ‘জিনতত্ত্ব’ আবার বাংলাদেশি বোলারদের সঙ্গেই ম্যাচ করে। সে তিনি পেসার কি স্পিনার হন না কেন। মুস্তাফিজুর রহমান ও সাকিব আল হাসান বৈশ্বিক টি-টোয়েন্টির বাজারে বড় নাম। কিন্তু মিরপুরে শরিফুল, সাইফউদ্দিন থেকে শুরু করে নাসুম আহমেদ, মেহেদী—কাউকে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই।

এ যেন চোখের পলকে পালাবদল! এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর—মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সম্ভাবনার অঙ্ক কেমন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে। কিউইদের বিপক্ষে খেলা আগের ১০ টি-টোয়েন্টির সবগুলোই হেরেছে বাংলাদেশ। সেই দলটার ভাগ্যেই কিনা আজ শুরু হওয়া সিরিজ ৫-০ দেখছে সবাই! মিরপুরের উইকেট অবশ্যই প্রভাবক, যেখানে গড়াগড়ি খায় টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং অহংকার। এই বাইশ গজে বোলাররাই প্রধান কুশীলব। পার্শ্বচরিত্রে ব্যাটসম্যানরা, যদিও আসল লড়াইটা তাঁদেরই—দুর্বোধ্য উইকেটে শতভাগ সামর্থ্য প্রয়োগের সঙ্গে ভাগ্যকেও পাশে পাওয়ার।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ