রাজশাহীতে পদ্মা পাড়জুড়ে দখলের প্রতিচ্ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কোথাও পিলার, কোথাও পাকা ভবন আবার কোথাও বাঁশ, খাম্বা দিয়ে দখল করা হয়েছে রাজশাহীল পদ্মার পাড়। একসময় যখন পদ্মার তীরে দাঁড়ালে এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যেত, এখন সেখানে শুধু চোখের সামেন পড়ে বিভিন্ন স্থাপনা। এমনকি সুকনো পদ্মার বুকে চরের মধ্যে ওপরের দিকে তাকালেও তীর দেখা মুশকিল। সমানে ভেসে আসে পদ্মাজুড়ে দখলের প্রতিচ্ছবি।

এ দখল নতুন নয়, বিগত অন্তত এক যুগ ধরেই চলে আসছে। হালে এসে দখলের মাত্রা আকাশসম গিয়ে ঠেকেছে। পদ্মার পাদ পেরিয়ে নদীর ভিতরে গিয়েও চলছে দখলের মহোৎসব। এ মহোৎসব থামছেই না। বুড়িগঙ্গা দখল করে যেমন ঢাকাকে মৃতপ্রয় নগরীতে পরিণত করা হয়েছিল, তেমনি পদ্মা দখল করে রাজশাহীকেও সেই কিণারাই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দিনের পর দিন।এই অবস্থায় রাজশাহীর সচেতন মহল চাইছেন দ্রুত পদ্মা পাড় থেকে শুরু করে নদী ঘিরে যেসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, সবগুলোই উচ্ছেদ শুরু করা হোক। তা না হলে অনতিবিলম্বে বুড়িগঙ্গার মতো দশা হবে পদ্মার। তখনই হয়তো নজরে আসবে প্রশাসনের।সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহীর বুলপুর থেকে শুরু করে একেপারে শ্যামপুর পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার জুড়ে পদ্মা পাড় দখল করে নানা ধরনের অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

এসব অবৈধ স্থাপনার মধ্যে সম্প্রতি যেসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে তার অধিকাংশ ফাস্ট ফুড বা রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলা হয়েছে। ‘কফি বার’ সীমান্ত নঙ্গর, সীমান্ত অবকাশ, ফাস্টফুডের দোকান, রেস্টুরেন্টসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে স্থানীয় সরকোর দলীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকজনও সারসরি জড়িত। বড়কুঠি এলাকার বিশাল জায়গা দখল করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন কফি বার গড়ে তুলেছে। বড়কুঠির সামনে কিছু দূর যেতেই পদ্মার তীর দখল করে দীর্ঘদিন ধরে ফাস্টফুডের ব্যবসা করে চলেছেন দরগাপাড়া এলাকার স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদ হাসান। অন্তত ১৫ বছর ধরে ওই জায়গাটি পদ্মা গার্ডেন নাম দিয়ে তিনি দখলে রেখেছেন।

আরো জানা গেছে, ২০১৪ সালের পদ্মা গার্ডেনের পশ্চিম দিকে শহর রক্ষা বাঁধের নিচে অন্তত ৩ একর জায়গা দখল করে লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে নগর সংস্থা। এরপর শহররক্ষা বাঁধের ওপর থেকে ওই জায়গাটি কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলার কাজ শুরু হয়।

পরে কাটা তারের বেড়া দিয়ে জায়গাটি ঘিরে ফেলা হলেও আর লিজ দেওয়া হয়নি। তবে বর্তমানে লালন শাহ পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে নগর সংস্থার। পার্ক গড়ে তোলা হলে হয়তো জায়গাটি একটি সৌন্দর্য ফিরে আসবে।লালন শাহ পার্কের একটু দূরেই নদী এবং তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সীমান্ত নোঙ্গর’ ও সীমান্ত অবকাশ নামে দুটি ফাস্টফুড কর্ণার। বিশালকার একটি আমবাগ ঘিরে এবং নদীরও বেশকিছু এলাকা দখল করে এখানে ভবন নির্মাণ করে ওই ফাস্টফুড কর্ণারটি গড়ে তোলা হয়েছে বছর সাতেক আগে। এরপর পর্যায়ক্রমে এখানে দখল চলছেইএছাড়াও পদ্মা তীর দখল করে গড়ে উঠেছে আরো শত শত প্রতিষ্ঠান। এতে করে একদিকে যেমন নদীর সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে শহররক্ষা বাঁধ। বাঁধের ওপরে অবাধ বিচরণের ফলে হুমকির মুখে পড়ছে বাঁধ।

বছর তিনেক আগে নগরীর শেখেরচক এলাকায় প্রায় ২০০ মিটার বাঁধ ভেঙে নদীতে চলে গেছে। ওই এলাকাতেও বাঁধ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত বাড়ি-ঘর।নগরীর শেখেরচক এলাকার আলতাফ হোসেন বলেন, ‘এই পদ্মা ছিল যৌবনে ভরা। আজ সে মৃতপ্রায় একটি নদী। সেই নদীকে আরো দিনের পর দিন মৃত বানিয়ে ফেলছে দখলদাররা। যে যার মতো দখল করে চলেছে নদী এবং নদীর তীর। আগে তীর দখল হতে দেখেছে। এখন দেখছে নদীর ভিতর দখর করেও গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এদের থামাবে কে?’রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী সওকতা রেজা মাহমুদ বলেন, ‘সময় পেলেই ছুটে আসি পদ্মার পাড়ে। কিন্তু পাড়ে হাঁটা যায় না বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বাড়ি-ঘরের কারণে। এখন হাঠতে হয় পাড়ের নিচ দিয়ে রাস্তা বা পদ্মার চরে। পদ্মার চরও দখল করে এখন গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে নদীর পাড় থেকে শুরু করে পদ্মাও তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে।

এভাবে চলতে থাকলে পানিশূন্য পদ্মার কারণে রাজশাহী নগরীও হুমকির মুখে পড়বে। আবার বর্ষাকালে হয়তো শহরে ঢুকে যাবে পানি।রাজশাহী সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, এই পদ্মা রক্ষায় আমরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি।

একসময় আন্দোরন করেছি পদ্মায় পানি ধরে রাখা নিয়ে। এখন হয়তো আন্দোলনে নামতে দখলদারদের হাত থেকে পদ্মা রক্ষার দাবিতে। এমনিতেই পদ্মায় পানি থাকে না, এর ওপর দিনের পর দিন দখলে পদ্মা ক্রমেই মৃতুপ্রায় নদীতে পরিণত হচ্ছে।’রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, কিছু জায়গা সৌন্দর্য বর্ধন করে সেগুলো লিজ দেওয়া হয়েছে। এতে করে বিনোদন পীপাশু মানুষ পদ্মা নদীর ধারে ঘুরতে গিয়ে মানুষ কিছু খেয়ে আরামে বসে থাকতেও পারছে। তবে পদ্মার তীরের দুটি জায়গা বাদে আর কোনো স্থান রাসিকের কোনো প্রতিষ্ঠান নাই।

এদিকে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন হোসেন বলেন, ‘পদ্মা যেভাবে দখল হচ্ছে-তাতে মনে হয় কেউ কেউ এটিকে গিলে খাচ্ছে। আমরা দখলরোধে নানা উদ্যোগ নিয়েই সফল হতে পারছি না।কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই যখন একাজে লিপ্ত হয়, তখন আমাদের আর কিছু করার থাকে না। তবুও আমরা চেষ্টা করছি পদ্মার তীর বা পদ্মাকে দখলমুক্ত রাখার জন্য।’

স/আর