শনিবার , ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ | ১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

নদী মায়ের কাজ করে-হাসান আজিজুল হক

Paris
জানুয়ারি ২৭, ২০১৮ ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলার কারণ হচ্ছে, নদী মায়ের কাজ করে। আমাদের ভূমি উর্বর হওয়ার কারণ হলো, এটি একটি নদীবহুল দেশ। বারবার বন্য হয়ে নদীগর্ভ থেকে প্রচুর পরিমাণে নরম মাটি উঠে এসেছে। সে জন্য আমাদের দেশকে একটা বদ্বীপের মতো বলা যায়। পানিপ্রবাহ আছে বলেই এ দেশ এত সুজলা-সুফলা, গাছপালায় ভরা। প্রকৃতি ও আবহাওয়া স্বাভাবিক আছে নদীর কারণেই। নদীগুলো প্রায় গাছের শিকড়ের মতো ছেয়ে আছে। সব নদী গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। সে কারণেই সেখানে ম্যানগ্রোভ তৈরি হয়েছে। কোনো পরিচয় না দিতে পারলেও আমরা বলতে পারব এই বদ্বীপ আমাদের।

গোটা ভারত উপমহাদেশে যে কটা বিখ্যাত নদী আছে, তার মধ্যে গঙ্গা খুব বড় নদী। এর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নাম রয়েছে। গঙ্গা ফারাক্কা থেকে মোড় নিয়ে দক্ষিণে ভাগীরথী হিসেবে বয়ে গেছে। কাটুয়া দিয়ে নবদ্বীপ পার হয়ে হুগলিতে যাওয়ার পরে নাম হয়েছে হুগলি নদী। এই ভাগীরথীর একদিকে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, অন্যদিকে নবাবদের কবর। ভাগীরথী এগিয়ে আসতে আসতে বর্ধমান জেলার কাটুয়া মহকুমায় এসে আবার পূর্বমুখো হয়ে যায়। সেটি আবার নবদ্বীপ হয়ে ফের গঙ্গা নাম নিয়ে কলকাতা হয়ে সাগরে মিশেছে। এর শাখা নদী হিসেবে পদ্মাকে বলতে পারি কি না; কিন্তু পদ্মাকে তো শাখা নদী বলা যাবে না। এটা আমাদের একটি প্রধান নদী। ফারাক্কায় বাঁধ না দিলে নদীটা মূলত আমাদের দিকে আসত। আমাদের দিকে মূল স্রোতটা আসত, কিন্তু সেখান থেকে দুই ধাপ কমে গেছে। তাতে করে আমাদের জনকষ্ট চলছে অনেক দিন।

ফারাক্কা হয়ে নদীটা চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোদাগাড়ী হয়ে আমাদের রাজশাহীতে পৌঁছে। কাজেই রাজশাহীর অন্য নাম হয় পদ্মাতীরের শহর। রাজশাহীকে পরিচিত করা যেতে পারে পদ্মাপারের শহর। পদ্মাপারে আরো অনেক রকমের জনপদ আছে। মানুষ সেখানেই থাকে, যেখানে পানি আর বাতাস পায়। পদ্মার আরেক নাম হলো কীর্তিনাশা। তার কারণ—এটি প্রবল স্রোতের নদী। এটি খুব ভাঙচুর করতে করতে এসে নানা জায়গায় এ পথে-ও পথে চলে গেছে। এটি কোনো সরল পথে যায়নি। যে পথে গেছে সেগুলোও বড় বড় শাখা নদী হয়ে গেছে। এটি একসময় যমুনার সঙ্গে মিলেছে। যমুনা আবার ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলেছে।

১৯৫৮ সালের দিকে রাজশাহীতে আমি যখন প্রথম আসি তখন চর ছিল অনেক কম, আর পানি অনেক বেশি। শীতকালে পানি কমে যেত; কিন্তু তাই বলে এখনকার মতো না। এখন স্রোত দেখাই যায় না। পুরোটাই চর। চর বেয়ে ওই পাশে গেলে কোনোমতে স্রোত দেখা যায় কি যায় না। তার আগে কিছু স্রোত আছে। পদ্মা নদী লম্বায় পাঁচ-ছয় শ মাইলের কম হবে না। এর প্রবল কীর্তিনাশা রূপটা না দেখলেও ভাঙতে দেখেছি। একটা বড় বাঁধ আছে, যাতে পানিটা ধাক্কা খেয়ে কিছু পানি ঘুরে আবার এই দিক দিয়ে আসে। তা না হলে রাজশাহীকেও টেকানো মুশকিল ছিল। পদ্মা রাজশাহীর অনেকটা গ্রাস করেছে, এখনো করছে। এর গতি কখন এদিক-ওদিক হয় কেউ বলতে পারবে না। এই নদী একসময় কুঠিবাড়ির গা ঘেঁষে যেত; কিন্তু এখন অনেকটাই দূরত্ব হয়ে গেছে।

আরেকটা নদী হলো আত্রাই। এখন এই নদীর দিকে গেলে দেখা যাবে প্রায় শুকনো। হেঁটে এপার থেকে ওপার যাওয়া যাবে। যেখানে একটু পানি দেখা যাবে সেখানে মাছ ধরার জাল ফেলা থাকে। এভাবে চলতে গিয়ে একসময় শুকিয়ে আসার মতো হয়ে গেছে। এই আত্রাই নদীর পাশ দিয়ে পতিসর গিয়েছে। এই আত্রাই নদীর দুই পারে ছিল প্রচুর জনপদ। সেখানকার মানুষ সব কাজের জন্য এই নদীকে ব্যবহার করত। পানি ছাড়া যেমন বাঁচব না, তেমনি নদী ছাড়াও বাঁচা কঠিন আছে। যেখানে নদী নেই সেখানে মানুষও নেই। তৈরি হবে মরুভূমি।

এসব নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, পানি কমে যাচ্ছে, এর কারণ প্রাকৃতিক হলেও মানুষের অনেক দায়ও আছে। মানুষ যখন-তখন যেখানে-সেখানে নদীকে ডাইভার্ট করে দেয়, পানি নিতে থাকে। তাই নদীও অনেক সময় প্রতিশোধ নেয়। ভূমির অবস্থা দেখে নদীর স্রোতের বাড়া-কমা নির্ভর করে। বেশি পানি না থাকলে ওপরে যেতে পারবে না। ভূমির উঁচু-নিচুতে নদীগুলো স্বাভাবিক হয় না।

নদী এখন অনেকটাই জীর্ণ হয়ে গেছে। পথঘাট জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অনেক পথ বেড়েছে দেশের মধ্যে। আগে ভালো বা পাকা সড়ক কল্পনাও করা যেত না। যেসব জায়গায় মাঠঘাট প্রান্তর দেখতে পাচ্ছি, সব একসময় বনভূমি ছিল। যে বাঘ সুন্দরবনে থাকে, আগে সে বাঘ এসব বনভূমিতে দেখা যেত।

নদী প্রকৃতির অংশ। নদী শুকিয়ে গেলে মানুষ আর কোথাও থেকে পানি পাবে না। যে নদীতে আগে নৌকা দিয়ে পার হতে হতো, এখন তা হেঁটেই পার হওয়া যায়। রাজশাহীতে অনেক নদী আছে যেগুলো মৃতপ্রায়। কিন্তু এই নদীগুলো বাঁচানোর জন্য কারো কোনো পদক্ষেপ নেই। এই নদীগুলো যে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নদী থেকে অতিরিক্ত পানি নেওয়া বন্ধ করে, যেখানে চর পড়েছে সেখানে ড্রেজিং দিয়ে নাব্যতা বাড়াতে হবে। সব যন্ত্রপাতি থাকার পরও কেউ গুরুত্ব দেয় না। এই অবহেলার কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে।

নদী এ দেশের মাতৃস্তনের মতো। মানব জাতির দুর্ভাগ্য সেদিন ব্যাপক হবে যেদিন নদীবহুল দেশগুলো স্থলবহুল হয়ে যাবে। নদীর নাব্যতা কমে যাবে। তখন দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন দেশের গণদুরবস্থা হবে। অসুখ-বিসুখ হবে, বাতাস পানি সব খারাপ হয়ে যাবে। আমরা এটা বুঝতে পারছি না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিবে। আমরা প্রকৃতির মধ্যেই তৈরি হয়েছি। প্রকৃতির দ্বারা আমরা সৃষ্ট। আমরা সেই প্রকৃতির দ্বারাই বেঁচে আছি। প্রকৃতিকে ধ্বংস করা মানে নিজেদের ধ্বংস করা। একে বাঁচিয়ে রাখলে মানুষও ভালো থাকবে। তা না হলে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

সর্বশেষ - মতামত