শুক্রবার , ২০ মার্চ ২০২০ | ৩রা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়াচ্ছে করোনা

Paris
মার্চ ২০, ২০২০ ৯:২০ পূর্বাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

সেদিন হেড অফিসের এক নিয়মিত সভায় গিয়েছিলাম। অন্যান্য দিনের মতো সভাপতি সাহেব সহাস্যে করমর্দনের জন্য হাত না বাড়িয়ে করোনা সংক্রমণজনিত ভীতির কথা বলে উচ্চস্বরে সালাম বিনিময় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন।

সভাপতির সঙ্গে অন্যরাও আগন্তুকদের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে করজোড়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। বুঝলাম, করোনা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি সচেতনতা নেয়া হয়েছে। ভাবলাম, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যহানির এ ক্রান্তিকালে এটাই স্বাভাবিক।

একজন প্রসঙ্গত গল্পচ্ছলে মধ্যযুগে ইউরোপের করোনাক্রান্ত একটি দেশের দুর্নীতি-ব্যাপকতার কথা স্মরণ করে আলোচনা জমিয়ে ফেললেন। তিনি জানালেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে দেশটিতে এত বেশি দুর্নীতি প্রচলিত ছিল যে, কেউ কারও সঙ্গে কোনো কাজের জন্য দেখা করতে গেলে দু’হাত ভরে উপঢৌকন নিয়ে যেতে হতো।

কারও অফিস বা বাড়ির দরজার কড়ায় হাত দিয়ে নাড়া দেয়ার উপায় না থাকায় পায়ের জুতার আঘাতে দরজার নিচে লাথি দিয়ে শব্দ করা হতো। মালিক বা কর্তা দরজা খুললে আগন্তুকের দু’হাত উপহার সামগ্রীতে ভর্তি থাকায় পরস্পরের জুতা পরা দু’পা দিয়ে ঠোকাঠুকি করে অভিবাদন পর্ব সমাধা করা হতো! এটাই সে সময়ের রেওয়াজ ছিল।

কালক্রমে মানুষ সভ্য হয়ে গেলে করমর্দনের প্রচলন ঘটে। এরপর মানুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা প্রকাশের ব্যাপ্তি হতে থাকলে কপালে ঘর্ষণ, গালে গালে ঠেস, চুম্বন পর্যন্ত চালু হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে করমর্দনের সময় ময়লা লাগার ভয়ে হাতে হাতমোজা পরার প্রচলন ঘটে। এরপর ফ্লু জাতীয় জীবাণুভীতির দিকটি প্রচারিত হলে নির্বাচনী জনসংযোগেও হাতমোজা পরে করমর্দনের বিষয়টিকে ভোটাররা মেনে নেয়। আর এখনকার দিনে বিভিন্ন পেশাদারি কাজের শুরুতে হাতমোজা পরিধান করাটাই নিয়ম।

করোনাতঙ্কে বর্তমান পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের মধ্যে মরণাতঙ্ক ঢুকে এক করুণ অবস্থা সূচিত করেছে। তা হবেই না বা কেন? চীনে ভয়াবহ সংক্রমণের পর শতাধিক দেশে করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে।

মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজারের মতো। এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন নয় হাজারের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে এতবড় মানবিক বিপর্যয় আর হয়নি। হাসপাতালগুলোতে হাতগ্লাভস্ আর হাজমাত স্যুটে পুরো শরীর ঢাকা ডাক্তার-নার্স আর লাইফসাপোর্টে থাকা হাজার হাজার রোগী। ইতালির সেনাপ্রধান ও ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনা সংক্রমণের শিকার হয়েছেন।

এদিকে ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে শত শত। সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল কমে গেছে। সীমান্তে সিলগালা করা হয়েছে অনেক দেশে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, আমদানি-রফতানিতে ভাটা পড়েছে। এজন্য বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় আমাদের দেশেও অনেক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে। জনসমাগম হয় এমন কর্মসূচি যেমন সভা, পিকনিক, ওয়াজ, বিয়েবাড়ি ইত্যাদির ওপর নজর রেখে জন-জটলা এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে ভ্রমণে নিষেধ করা হচ্ছে।

দেশে দেশে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ায় কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক দেশে পর্যটন বন্ধ। ওমরাহ রেজিস্ট্রেশন বন্ধ, তাজমহল বন্ধ। অনেক এলাকা ‘লকড্’ করা হয়েছে। পুরো ইতালিকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। এতকিছুর পরও জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে হয়। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে বসতে হয়, কাঁচাবাজারের পথে ছুটতে হয়। সেজন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের লিখিত সতর্কবার্তায় প্রয়োজনীয় মাস্ক পরে জনভিড় এড়িয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে ঘরে ফেরার তাগিদ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া অহেতুক আতঙ্কিত ও বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মানসিক শক্তি তৈরি করতে হবে। গুজবে কান দিয়ে বিচলিত হয়ে বেশি বেশি কেনাকাটা না করতে বলা হয়েছে।

করোনাভীতি সৃষ্টি ও ছড়ানোর জন্য একশ্রেণির হতাশাগ্রস্ত ও দুষ্ট মানুষ কিছুটা দায়ী। তারা কোনো ঘটনার আদ্যোপান্ত না জেনেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভীতিকর জিনিস পোস্ট করছে। এ বিষয়ে তাই সবার সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করা উচিত।

আমরা জানি, মৃত্যুভয় সব প্রাণীর সবচেয়ে বড় ভয়। এ ভয়কে জয় করার জন্য মানুষের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা সবাই এ সুন্দর পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চাই। পৃথিবীটা নশ্বর, সবাই জানি।

তবুও এর আলো-বাতাসের প্রতি সবার বড়ই আকর্ষণ। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা পৃথিবী নামক বাড়িটার মোহকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ভালোবাসা চিরন্তন। এ ভালোবাসাকে হাতমোজা পরে হলেও করমর্দনে রাখার চেষ্টা করি।

আমাদের অবহেলা ও অমানবিক উদাসীনতায় প্রীতি-ভালোবাসা ‘লেগশেক’ বা পা কম্পনে গড়াতে গড়াতে যেন ধুলোয় মিশে না যায়। কারণ ‘লেগশেক’ একটি মানসিক চাপজনিত রোগের নামও বটে। মনুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধার শৈথিল্য ও ক্রমাগত অবমাননা হতে থাকলে সেখানে মানবতা অচিরেই মাটিতে মিশে উধাও হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

এতদিন গড়িয়ে যাওয়ার পরও দেশে দেশে করোনা সংক্রমণ প্রবণতা নিঃসন্দেহে মানুষকে হতাশ করে তুলছে। এর ভীতি মানুষকে দিন দিন স্বার্থপর করে তুলছে, যা মোটেও কাম্য নয়। ঘরে ঘরে আবদ্ধ করে রেখে এটি মানুষের মাঝে দূরত্ব দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

করোনায় মানুষের সর্বজনীন দূরত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটি বড় আশঙ্কার বিষয়। করোনা সংক্রমণ নামক অন্ধকারের কালিমা দূর করতে আশু বিশেষ আলোর পরশ দরকার। এজন্য আসুন, সবাই নতুন করে আত্মবিশ্বাসী হই।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

fakrul@ru.ac.bd

সর্বশেষ - মতামত