এসব অস্ত্র-গোলাবারুদের গন্তব্য ছিল কোথায়?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের (পূর্বাচল-৫ নম্বর সেক্টর) একটি কৃত্তিম জলাধার থেকে ২১টি ব্যাগে বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। গত বছর দিয়াবাড়ির একটি জলাধর থেকেও উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এই দুই জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যাগ ও অস্ত্রের ধরণে মিল রয়েছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে একই চক্রের হাতে এসব অস্ত্র ছিল। এখন প্রশ্ন উঠেছে উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্রের গন্তব্য ছিল কোথায়? কারা এই বিপুল অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল? কেন সংগ্রহ করেছিল? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল?

এ বিষয়ে শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে আইজিপি শহীদুল হক বলেন, ‘এরই মধ্যে এক ব্যক্তি আমাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। ওই ব্যক্তির তথ্যের ভিত্তিতে এই সব অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এই চক্রের হাতে আরও অস্ত্র-গোলাবারুদ আছে কিনা খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারা কী কারণে, কী উদ্দেশ্যে এই গোলাবারুদ মজুদ করেছে তা শিগগিরই জানা যাবে।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার শরীফ খান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর বাসা থেকে প্রথম একটি এসএমজি উদ্ধার করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শরীফের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। শরীফ সে সময় বাসায় না থাকলেও তার রান্নাঘর থেকে একটি এসএমজি উদ্ধারের দাবি করে পুলিশ। পরদিন আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাত থেকে অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

তবে শরীফের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ফাহিমা বেগম বলেন, ‘গত ২৯ মে মামলার শুনানির দিন থাকায় সকাল ৬টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায় শরীফ। দুপুরের দিকে সাদা পোশাকে প্রথমে দু’জন পুলিশ বাসায় গিয়ে শরীফের খোঁজ করে। পরে আরও কয়েকজন পুলিশ বাসায় প্রবেশ করে রান্নাঘর তল্লাশী করতে চায়। আমি এসময় রান্না ঘরে ছিলাম।’

ফাহিমা আরও বলেন, ‘পুলিশ আমাকে শোয়ার ঘরে যেতে বললে আমি চলে যায়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আমাকে ডেকে বলে রান্নাঘরের চাল রাখার ড্রামের আড়ালে অস্ত্র পাওয়া গেছে। একজন মেয়ে মানুষ দিনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই সময় কাটায়। রান্না ঘরে অস্ত্র থাকলে আমার চোখে পড়তো। রান্না ঘর থেকে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি অবিশ্বাস্য।’

এ সময় ফাহিমা প্রশ্ন করে বলেন, ‘পুলিশ এসে মাদক উদ্ধারের জন্য বলেছিল। কিন্তু পরে অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলে। আর অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাগও এনেছিল। তারা অস্ত্রের কথা কি আগে থেকেই জানতো? তাহলে মাদকের কথা বললো কেন?’

এদিকে, একজন মাদক ব্যবসায়ী কেন এতো অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল? এমন প্রশ্নে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা কোনও সদুত্তর দিতে পারেন নি। তারা বলেন, গ্রেফতার শরীফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। উদ্ধার করা অস্ত্র দেখে মনে হচ্ছে, তা দেশের কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য আনা হয় নি। এগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর জন্য আনা হয়ে থাকতে পারে। সুযোগ বুঝে এসব অস্ত্র পাচার করে দেওয়া হতো। বাংলাদেশকে শুধু ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কারখানায় তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশের জঙ্গিদের আগে ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার অস্ত্র ও গোলাবারুদের সঙ্গে এসব অস্ত্রের কোনও মিল নেই।’

অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য

রূপগঞ্জের অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। শুক্রবার সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর জলাধারে বিপুল অস্ত্র লুকিয়ে রাখার বিষয়টি জানা যায়। ফায়ার সার্ভিসের একজন সদস্য বলেন, অস্ত্র উদ্ধারের সময় পুলিশ দুই ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘শরীফ খান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।’

এদিকে শরীফের বাসা থেকে পাওয়া এবং তাকে গ্রেফতারের দিনক্ষণ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রূপগঞ্জ থানা পুলিশ বলছে, গত ৩০ মে মঙ্গলবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শরীপের দাউদপুর ইউনিয়নের বাগলা গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। তার বাসা থেকে একটি অস্ত্র উদ্ধারের পর ওই দিনই তার বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পরদিন ৩১ মে মাদকের একটি পুরানো মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে যায় শরীফ। পুলিশের পক্ষ থেকে নতুন করে অস্ত্র মামলার বিষয়টি আদালতকে জানানো হলে তার জামিন বাতিল করেন আদালত। ওইদিন আদালত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মাহমুদুল হক শুক্রবার রাতে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রূপগঞ্জের বর্ডার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় শরীফকে। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযান চালানো হয়।’

অপরদিকে দুপুরে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকা থেকে শরীফকে গ্রেফতার করা হয় ।’

খোদ পুলিশের একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অস্ত্র উদ্ধারের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ী শরীফের জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘অস্ত্রের ধরণ দেখেই বোঝা যায় এসব অস্ত্র কোথায় পাঠানো হচ্ছিল। রকেট লঞ্চার, টাইম ডিভাইস, ওয়াকিটকি বা এসএমজি সাধারণ সন্ত্রাসী বা ক্যাডাররা ব্যবহার করে না। এসব ব্যবহৃত হয় সাধারণত দুর্গম অঞ্চলে আত্মগোপনে থাকা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো।’

অস্ত্র উদ্ধার টিমের সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্রগুলো উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো কারখানায় তৈরি। যদিও অস্ত্রের গায়ে উৎপাদনকারী দেশের নাম উল্লেখ নেই। তবে অস্ত্রের ধরণ দেখে এগুলো চীনে তৈরি বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকও এসএমজিগুলো চাইনিজ বলে জানান।

অভিযানে উদ্ধার হওয়া গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চারের প্রজেক্টর নিষ্ক্রিয়কারী সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের  একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেনেডগুলি সক্রিয় ছিল না। গ্রেনেডের সঙ্গে ডিফিউজ বা বিস্ফোরণ করার যে সার্কিট থাকে সেসব কাজ করছিল না। পরে নিজস্ব পদ্ধতিতে তা ডিফিউজ করা হয়।

রূপগঞ্জ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- ৬১টি এসএমজি বা সাব মেশিনগান, ২টি রকেট লঞ্চার, ২টি ওয়াকিটকি, ৫টি ৭ পয়েন্ট ৬২ বোরের পিস্তল,  ৪৯টি রকেট লঞ্চার প্রজেক্টর, ৪২টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৪৪টি এসএমজির ম্যাগজিন, বিপুল পরিমাণ টাইমফিউজ, ইগনাইটার ও গুলি। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন