বাগমারায় ইটভাটার ধোঁয়ায় আম-লিচুর সর্বনাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর বাগমারায় গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে এবার কপালে হাত পড়েছে হাজার হাজার আম ও লিচু চাষির। ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে এবার বেশির ভাগ লিচুবাগানে মুকুলই আসেনি। আবার আমের মুকুল এলেও এখন সেই আম পচে ঝরে যাচ্ছে। ফলে লিচু ও আম চাষিরা এবার ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এ নিয়ে এলাকার আম চাষিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ। কিন্তু এই ক্ষতির পেছনে যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তর।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে ইটভাটা থেকে মাসিক মোটা অঙ্কের চাঁদা তোলা হয় বিভিন্ন অজুহাতে। এর একটি অংশ যায় উপজেলা প্রশাসনের কাছে, আরেক অংশ যায় পরিবেশ অধিদপ্তরে।

বাগমারা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাজিবুর রহমান বলেন, ‘ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে এবার বাগমারার বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ আম নষ্ট হচ্ছে। কোনো কোনো গাছের সব আম ঝরে পড়েছে। আবার লিচুরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ইটভাটার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ প্রশাসন নিচ্ছে না। ’

রাজিবুর রহমান আরো জানান, ইটভাটার মালিকরা সঠিক নিয়মে ইটভাটা তৈরি করেছে কি না, কৃষিজমিতে করেছে কি না, আবার আবাসিক এলাকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে করা হয়েছে কি না এমনকি নিয়মমতো জ্বালানি পোড়ানো হয় কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু তারা এসব নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, যে কারণে বাগমারায় ইটভাটার প্রভাবে ক্ষতিটাও অনেক বেশি।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আমরা ইটখোল মালিকদের মৌখিকভাবে এমনকি আইনগতভাবেও সঠিক নিয়মে ইটভাটা তৈরি করতে ও ইট পোড়ানোর কথা বলে আসছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বরং ইটভাটাগুলোর চিমনি করা হয়েছে নিয়মের বাইরে এবং বিপুল পরিমাণ কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে আশপাশের গাছপালায় এবার আর তেমন ফল আসেনি। ফলে কৃষক ও আম চাষিরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে। ’

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাগমারা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে গোয়ালকান্দি ইউনিয়নে। তাহেরপুর পৌরসভা সদর থেকে ব্রিজটি পার হলেই এ ইউনিয়নের রামরামা গ্রাম। গ্রামের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় আমগাছগুলোর দিকে তাকাতেই চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা হয়। কারণ গাছে যেসব আম ঝুলছে, এর অধিকাংশ আমের নিচের দিকে পচে গাঢ় কালো রঙের আকার ধারণ করেছে। আবার গাছের নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল পচা ও কালো রঙের আমে ভর্তি হয়ে আছে গাছের চারদিক। কোনো কোনো গাছে দেখা যায়, দু-একটা আম ঝুলছে। কিন্তু আমের মোটা বোটাগুলো এখনো রয়েছে। দেখে মনে হবে, দু-একদিন আগেই হয়তো সব আম পেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গাছের নিচের দিকে তাকালেই সেই ভুল ভেঙে যাবে। কারণ গাছের নিচেই পড়ে আছে গাছ থেকে পচে ঝরে পড়া আমগুলো। কোনো আম পচে শুঁটকির মতো হয়ে গেছে।

শুধু রামরামাই নয়, এ অবস্থা ওই ইউনিয়নের থান্দারপাড়া, জলপাইপাড়া, তালতলী, পাশবার্ত পুঠিয়া উপজেলার সরগাছিসহ আশপাশের প্রায় সব গ্রামেই। এ গ্রামগুলোতে পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ৯টি ইটভাটা। আর সেই ইটভাটার ধোঁয়ার প্রভাবে ওই ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের অন্তত ৯ শতাংশ গাছের আম নষ্ট হয়ে পচে যাচ্ছে। এবার লিচু বাগানগুলোতে যেন মুকুলই আসেনি বলে দাবি করেছেন কৃষক ও আম চাষিরা।

বাগমারার রামরামা গ্রামের আম চাষি আব্দুল মতিন অভিযোগ করে জানান, তাঁর দুটি বাগান মিলে ১৯টি আমগাছ আছে। এগুলো থেকে প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ টাকার আম বিক্রি করা যায়। কিন্তু এবার বিক্রি তো দূরের কথা, বাড়ির সদস্যদের নিয়ে আম খাওয়াও হবে না।

আব্দুল মতিন বলছিলেন, ‘ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে এবার গাছেই আম নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছে না। কারণ প্রতি মাসে দু-একজন লোক এসে এসব ইটভাটা থেকে মাসোয়ারা আদায় করে নিয়ে যায়। শুনেছি তারা প্রশাসনের লোক, যে কারণে ভয়ে কেউ কথা বলে না। অথচ ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে এবার অন্তত শুধু গোয়ালকান্দিতেই কোটি টাকার আমের ক্ষতি হয়েছে। ’

রামরামা থান্দারপাড়া গ্রামের মান্নান থান্দার কালের কণ্ঠকে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশেই ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ধোঁয়ার কারণে অনেক সময় বাড়িতেই থাকা দায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় গাছের আম টিকে থাকেব কী করে? আম তো খুব সোহাগি জিনিস। ওকে অনেক যত্ন করেই চাষ করতে হয়। এ অবস্থায় ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় আমের মতো সোহাগি জিনিস গাছে টিকে থাকার কথা নয়। এটিই হয়েছে এবার। ’

একই গ্রামের ইয়াছিন মোল্লা বাড়ির পাশে গড়ে ওঠা পাশাপাশি চারটি ইটভাটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এই দেখেন, কিভাবে গড়ে উঠিছে ইটখোলা (ইটভাটা)। ফসলের জমিতে যেভাবে ভাটাগুলো তৈরি করা হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে পাশাপাশি বাড়ি করেছে ওরা। এসব ইটভাটাই আমাদের এবার সর্বনাশ করিছে। আমরা এই সর্বনাশের ক্ষতিপূরণ চাই। না হলেও সামনের বার যেন এসব ভাটা বন্ধ থাকে, এর ব্যবস্থা চাই। ’

বাগমারার বৈলসিংহ গ্রামের আলতাফ মোল্লা অভিযোগ করে জানান, ইটভাটার কারণে এবার আমের পাশাপাশি লিচুরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাঁর বাগানের ২৫০ লিচুগাছের মধ্যে বড়জোর ২০-২৫টি গাছে এবার ভালোভাবে লিচু এসেছে। আর বাকি গাছগুলোতে একেবারেই লিচু আসেনি। শুধু পাতায় ভরে আছে। ইটভাটার প্রভাবের কারণেই এমনটা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

স/আর