পূর্ব ইউরোপীয় অভিবাসীদের নিয়েই ব্রিটিশ ভোটারদের যত আপত্তি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: ব্রিটেনে যেসব ইস্যুতে এবারের নির্বাচন হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় অভিবাসন। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই ইস্যুতে সোচ্চার, বলতে গেলে এটাই যেনো তাদের একমাত্র নির্বাচনী এজেন্ডা।এই চাপের মধ্যে মূলধারার বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোকেও অভিবাসনের বিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরতে হচ্ছে। এর কারণ- ব্রেক্সিট গণভোট, যাতে অভিবাসন ঠেকাতে ভোটাররা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দেয়। আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে অভিবাসন কতো বড়ো ইস্যু আর অভিবাসীরাই বা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন? তারই খোঁজ নিতে মিজানুর রহমান খান গিয়েছিলেন বিদেশি অধ্যুষিত শহর লেস্টারে।

তারই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম বিদেশি অধ্যুষিত একটি শহর লেস্টারে। এই শহরটির সাথে বাংলাদেশের অনেকেই হয়তো গত বছর পরিচিত হয়ে উঠেছেন যেবার শহরের ক্লাব সবাইকে চমকে দিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নিয়েছিলো।

লন্ডন থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরের এই শহরে অর্ধেকেরও বেশি বিদেশি। আফ্রিকা আর এশিয়া থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৬০/৭০ বছরে এসেছে হাজার হাজার অভিবাসী।

কিন্তু গত এক দশকে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে পোল্যান্ড থেকে এসেছে বহু মানুষ। ইউরোপের ওই অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীরা শহরের চেহারা ও রাজনীতিতে কিছুটা আলোড়ন তুলেছে।

সিটি সেন্টারের একটি বেঞ্চে বসেছিলেন শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ নরম্যান ব্রেকেনব্রিজ। এই শহরে আছেন ৪০ বছর। চাকরিসূত্রে বেশিরভাগ সময়ই থাকেন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করতে এসেছেন ছুটির দিনে। বললেন, এই শহরকে এখন আর চেনা যায় না।

তিনি বলেন, “এই দেশে অভিবাসন একটি বড়ো ইস্যু। বিদেশিদের যারা কাজ করছে তাদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ থেকে যতো মানুষ এসেছে তারা কোন কাজ করে না। রাস্তায় তাদেরকে ভিক্ষে করতে দেখবেন।”

“করদাতাদের অর্থ দিয়ে সরকারের তাদেরকে দেখভাল করতে হয়। এশীয়দের নিয়ে এই সমস্যা নেই। তারা কাজ করেন,” বলেন তিনি।

লেস্টারে বাংলাদেশীও আছে প্রচুর। বেসরকারি হিসেবে ৮/৯ হাজারের মতো। বেশিরভাগই থাকেন হাইফিল্ডস, এভিংটন এলাকায়। এখানকার এক দম্পতি মাইনুল-মুন্নি। স্ত্রী মুন্নির জন্ম এখানেই। কিন্তু মাইনুল হোসেন এসেছেন বৈবাহিক সূত্রে।

বাঙালিদের অনেকেও চান না যে পূর্ব ইউরোপ থেকে লোকজন আসুক। মাইনুল ও মুন্নির মতো অনেকেরই ধারণা, নতুন যারা আসছে তারা তাদের চেয়ে আলাদা।

স্ত্রী মুন্নি জানালেন, পূর্ব ইউরোপ থেকে প্রচুর লোকজন আসার পর থেকে শহরে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। তিনি জানান, তারা আগে কখনো চুরি বা ছিনতাই এর কথা শোনেননি। কিন্তু এখন তারা এসব খবর পাচ্ছেন।

মাইনুলও জানালেন পূর্ব ইউরোপের লোকজন আসার ফলে শহরে শ্রম অনেক সস্তা হয়ে পড়েছে। মালিকরা খুব অল্প খরচে শ্রমিক পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে দক্ষ লোকদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে।

পোলিশ বিল্ডার ইয়ানো জার্মানি থেকে বছর পাঁচেক আগে এসেছেন এই শহরে। নির্মাণ শ্রমিক। শহরের রেল স্টেশনের কাছে একটি চিকেন চিপসের দোকান নির্মাণে কাজ করছিলেন।

তিনি মনে করেন, বিদেশিরা যে কাজ করতে আসছে এটা ভালো। “তারা এখানে কাজ করছে। এমন নয় যে তারা শুধু আসছে। ব্রিটিশ লোকজন তো আগে আমাদের এই আসার ব্যাপারে খুশি ছিলো। এখন খুশি না কেনো? কি হয়েছে?” প্রশ্ন তার।

কিন্তু তরুণদের এনিয়ে খুব একটা আপত্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলছিলেন, কোনো অভিবাসী কোন দেশের বা কোন ধর্মের সেভাবে তিনি কাউকে আলাদা করতে চান না।

সাইকেল নিয়ে বিএমএক্স রাইডিং করছিলো একদল তরুণ। তাদের অনেকেও বললো, বিদেশিদের আসায় তাদের তেমন কোন আপত্তি নেই। তাই নির্বাচনে তাদেরকে ইস্যু করার কি আছে?

এরকম একজন বললেন, “এটা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমরাও তো অন্য দেশে যাই। তাহলে তারা আসলে সমস্যা কোথায়? এসব নিয়ে শুধু রাজনীতি হয়।”

৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেস্টারে আছেন শফিকুল ইসলাম চৌধুরী। স্থানীয় একজন কাউন্সিলর তিনি। বললেন, এই শহরের নির্বাচনে অভিবাসন কোন ইস্যু নয়।

কারণ হিসেবে বললেন, যেহেতু এখানে অভিবাসীর সংখ্যা অনেক এবং স্থানীয় অর্থনীতিতেও তাদের বড় রকমের ভূমিকা আছে তাই এটা নিয়ে তেমন একটা সমস্যা নেই। তিনি জানান, এখানকার স্থানীয় শ্বেতাঙ্গরাও বিদেশিদের প্রতি খুব বেশি খারাপ মনোভাব পোষণ করে না।

তবে এই শহরে আগে থেকেই যেসব বিদেশি অভিবাসী আছেন তাদের আপত্তি রয়েছে নতুন অভিবাসী আসার ব্যাপারে।

“তারা নতুনদের থেকে নিজেদের আলাদা মনে করে। তাদের এই বিরোধিতার কারণ হলো নতুনরা এলে তাদের সরকারি ভাতা বাড়িঘর, এমনকি কাজ পাওয়ার ব্যাপারে আরো প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হতে পারে বলে তাদের এই আশঙ্কা।”

মি. চৌধুরী সপ্তাহে একদিন বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়ান। ছাত্রী আনিকা রহমান মনে করেন, মূলধারার সাথে না মেশার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

লেস্টার শহরের মাঝখানের একটি সড়ক নরবরা রোড। এই সড়কের দু’পাশে দু’শোরও বেশি দোকান। এসব দোকান যারা চালান তাদের মধ্যে রয়েছে চারটি মহাদেশের ২৩টিরও বেশি দেশের মানুষ।

তাদের মধ্যে উগান্ডা, তাজিকিস্তান, ক্যানাডা, পাকিস্তানি, ইরাকি যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছে বাংলাদেশীরাও। কিন্তু গত পাঁচ ছ’বছরে এই সড়কের দু’পাশে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। বদলে গেছে সড়কের চেহারা। পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা লোকজন এখন প্রচুর দোকান খুলেছেন।

এখানেই একটি পোলিশ রেস্তোরায় কাজ করেন বারবারা। এসেছেন সাত বছর আগে।

তিনি বললেন, “আমি তো খুব খুশি। সবাই সবার বন্ধুর মতো। বহু দেশের মানুষ যখন একসাথে থাকে সেটা তো অনেক ভালো জিনিস। আমার কোন সমস্যা হয়নি। কখনোই না।”

নির্মাণ শ্রমিক ইয়ানো যার অধীনে কাজ করছিলেন তিনিও একজন অভিবাসী শ্রমিক- আইরিশ। তার মতে, ব্রিটেনের হাতেগোনা কিছু সংখ্যক লোকজনের কাছে এটা নির্বাচনী ইস্যু।

“বেকার ইংরেজদের কাছে এটা একটা ইস্যু। বাকিদের তো কোন সমস্যা হয় না। প্রতিদিনই আমরা তাদের সাথে কাজ করছি। তারা কেনো আপত্তি করবে? লোকজনের আসা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের অর্থনীতি কিভাবে চলবে?” বলেন তিনি।

কিন্তু এসব নিয়ে কোন চিন্তা নেই চিকেন চিপসের দোকানে কাজ করছিলেন যে পোলিশ শ্রমিক সেই ইয়ানোর। হাসতে হাসতে তার স্পষ্ট কথা- “এতো কিছু ভাবি না। আজ কাজ শেষ করবো। তারপর এক বোতল হুইস্কি কিনবো। তারপর কাল দেখা যাবে কি হয়।”