সোমবার , ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ | ১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

সাড়ে তিন বছর নেই রাজশাহী নগরীতে উন্নয়ন: বেড়েছে ট্যাক্সের বোঝা ও ক্ষোভ

Paris
জানুয়ারি ২৩, ২০১৭ ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত ২০১৩ সালের ১৫ জুন। এ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ ভোট এবং মহাজোটের প্রার্থী ও সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ৮৩ হাজার ৭২৬ ভোট। সবমিলিয়ে ৪৭ হাজার ৩৩২ ভোটের ব্যবধানে বুলবুল মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে লিটনের কাছেই ২৩ হাজার ৮১০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন বুলবুল। সেইবার নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকেই শিক্ষা নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট নদীর ধার, পার্ক আইল্যান্ড এমনকি নগর ভবনেও উন্নয়নের ব্যাপক ছোয়া লাগে। শহরের রাস্তা ঘাটগুলো হয় ঝকঝকে তকতকে। যেন প্রাণ ফিরে পায় সবুজ নগরী রাজশাহী। সবমিলিয়ে লিটন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় রাজশাহীতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন হয়।

 

কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে বুলবুল মেয়র হওয়ার পর থেকে রাজশাহী শহরের জন্য এখন পর্যন্ত একটিও বৃহৎ কোনো প্রকল্প পাশ হয়নি। তবে নগরবাসীকে বিভিন্ন নিষ্পেশিত করতে বেড়েছে ট্যাক্সের বোঝা-এমনটিই অভিযোগ করছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী মহল।

 

নগরবাসী মনে করছেন, রাজশাহীতে উন্নয়ন থমকে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো নির্বাচিত মেয়র ক্ষমতায় না থাকা এবং সরকার দলীয় মেয়র নির্বাচিত না হওয়া। বুলবুল মেয়র নির্বাচিত হলেও ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে নাশকতার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি টানা প্রায় এক বছর আত্মগোপনে ছিলেন। এই সময়ে নির্বাচিত মেয়রকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং তাঁর স্থলে দায়িত্বভার দেওয়া নিয়ে নানা নাটকিয়তার জন্ম দিয়েছে সরকার।
রাসিক সূত্র মতে, সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সময়কালে রাজশাহী নগরীতে যে ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন বা প্রকল্প অনুমোদন হয়, তার মধ্যে ছিল ৫১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর ফায়ার ব্রিগেড ক্রসিং থেকে উত্তর নওদাপাড়াস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নাটোর মহাসড়ক পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, ২৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর সড়কসমূহ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প, ৫২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় নগরীর ভৌত অবকাঠামো, ড্রেনেজ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প, ৭৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ১৫ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সিটি ভবন কমপ্লেক্স নির্মাণ, ৭২ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর উপশহর মোড় হতে সোনাদিঘি মোড় এবং মালোপাড়া মোড় হতে সাগরপাড়া মোড় পর্যন্ত সংযোগ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প অনুমোদন, ১২২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী-নওগাঁ রোড হতে মোহনপুর-রাজশাহী-নাটোর রোড পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার সংস্কার ও উন্নয়ন করা, এবং ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাহেব বাজার বড় মসজিদ নির্মাণকাজ সম্পন্নকরণ উল্লেখযোগ্য।

 

  • এরপর ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণের পরে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নগরীর উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেন।

 

এসবের মধ্যে ছিল  ২০৬ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ২ একর আয়তনের ১৭টি প্রাকৃতিক জলাধার ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ প্রকল্প, ৪৬৯ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প। ১২৬ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৯৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে পদ্মাতীরকে পর্যটন কেন্দ্রে উন্নয়ন ও আদর্শ বিনোদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ইকোপার্ক নির্মাণ প্রকল্প, ৬৬ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৬৩টি সড়ক সংযোগস্থল প্রশস্তকরণ ও ৩০ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণ, সড়ক বিভক্তিকরণ এবং ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্প, ৮০ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে শিশুদের জন্য নগরীর বড় বনগ্রাম এলাকায় শহীদ জিয়া শিশু পার্ক নির্মাণ প্রকল্প, ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর গ্রেটার রোড হতে নওদাপাড়া পর্যন্ত সড়কটির পাশে ১০ বিঘা এলাকা নিয়ে একটি ওয়াটার পার্ক নির্মাণ পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে এসব প্রকল্পের একটিও আলোর মুখ দেখেনি বলে নিশ্চিত করেছে রাসিকের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো।

 

  • তবে ২০১৪ সালে ১২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারী পর্যন্ত রাস্তা প্রসস্তকরণ কাজের একটি প্রকল্প পাশ হলেও এটিও নেওয়া হয়েছিল সাবেক মেয়র লিটনের আমলে। কাজেই নতুন করে কোনো প্রকল্পের আলোর মুখ দেখেনি গত সাড়ে তিন বছরে।

শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ৭ মে নির্বাচিত মেয়র বুলবুলকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করে তাঁর স্থলে ওই বছরের ৩১ মে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম-উল আযীমকে। সিটি করপোরেশনের তিন তিনটি প্যানেল মেয়রকে বাদ দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অবৈধভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন সাধারণ কাউন্সিলর নিযাম-উল-আযীমকে। এরপর নগরীর উন্নয়ন আরো থমকে পড়ে। এই সময়ে নগরীর রাস্তা-ঘাটগুলোও সংস্কার করার মতো কোনো প্রকল্প হাতে নিতে পারেননি নিযাম-উল-আযীম।

  • অভিযোগ রয়েছে, উন্নয়ন না হলেও এ সময়ে নগর ভবনে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ তোছরুপ করছেন নিযাম-উল-আযীম। এতে করে নগরবাসী বিভিন্ন সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

 

 
নগরীর উপশহর এলাকার বাসীন্দা রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়র লিটনের আমলে রাজশাহীর চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বুলবুল মেয়র হওয়ার পরে রাজশাহীর উন্নয়ন যেন থমকে গেছে। প্রক্ষান্তরে বেড়েছে নগরবাসির বিভিন্ন ট্যাক্স। উন্নয়ন সুবিধা থেকে রাজশাহী বঞ্চিত হলেও ট্রাক্সের গ্যাঁড়াকলে পড়ে হাঁসফাঁস খেতে হচ্ছে নগরবাসীকে।’

 

  • রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সেকেন্দার আলী বলেন, ‘নগরীর উন্নয়ন থমকে যাওয়ার পাশাপাশি এখানকার ব্যবসা-বানিজ্যেও ভাটা পড়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে লাইনেন্স ফি ও সাইনবোর্ড ফি বর্ধিতকরণ করা হয়েছে কয়েক শ গুন। এমনকি আগে যেখানে সাইনবোর্ডের কোনো ট্যাক্স দিতে হত না, এখন সেখানে বছরে হাজার হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হচ্ছে নগরীর ব্যবসায়ীদের। এতে করে ক্ষোভ বেড়েছে মানুষের মাঝে। এ নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। হরতালও হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সিটি করপোরেশন তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে না।’

রাজশাহী নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক বিশিষ্ট আইনজীবী এনামুল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘ট্যাক্সের যন্ত্রণায় নগরবাসীর হাঁসফাঁস ধরে গেছে। তারা এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান। কিন্তু দিন দিন কোনো সুবিধা না বাড়িয়ে একের পর এক হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স ও সাইনবোর্ড ফি বেড়েই চলেছে। আমরা ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তবে আমরাও ছাড়ব না। এর শেষ দেখেই ছাড়ব। নগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ব্যবসার পরিসর যতদিন বৃদ্ধি না হবে, ততদিন আমরা কোনো বর্ধিত ট্যাক্স দিব না।’

 

  • নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা আজমা চৌধুরী, ব্যাবসায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতি হারুন-উর-রশিদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এভাবে উন্নয়ন বঞ্চিত হয়ে কোনো নগরী টিকে থাকতে পারে না। নির্বাচিত মেয়রছাড়া নগরীর উন্নয়ন সম্ভব না। আবার নগরবাসীর সমস্যার সমাধানও কেবল তার পক্ষেই সম্ভব।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে বের হওয়া সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আজিবুল হক বলেন, ‘গত কয়েক বছরে নগরীর কোনো উন্নয়ন চোখে পড়ছে না। অথচ তার আগের পাঁচ বছরে রাজশাহীর ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। সেই উন্নয়নের ছোঁয়ায় নগরী এখনো জ্বল-জ্বল করছে। কাজেই বোঝা যায় সরকার দলীয় মেয়র না হওয়ায় নগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে আছে। সরকার দলের নির্বাচিত মেয়র থাকলে অবশ্যই তদ্বিবর তদারকি করে তিনি বিভিন্ন প্রকল্প বের করে আনতে পারতেন মন্ত্রণালয় থেকে। যা সরকার দলের বাইরের মেয়র বা সাধারণ একজন কাউন্সিলরের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’

 

  • নগরীর উন্নয়ন থমকে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, ‘গত সাড়ে তিন বছরে রাজশাহী নগরীর জন্য নতুন কোনো প্রকল্প পাশ হয়নি। একটি প্রকল্প পাশ হলেও সেটিও আগেই প্রস্তাবনা দেওয়া ছিল মন্ত্রণালয়ে। ফলে এই সময়ে তেমন কোনো উন্নয়নও হয়নি। নতুন করে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় আমরা কোনো উন্নয়ন কাজও করতে পারছি না।’

জানতে চাইলে নগর সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম-উল-আযীম বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন করার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকার থেকে নতুন কোনো প্রকল্প ছাড় না করায় তা থমকে আছে। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
উন্নয়ন না হলেও নগর সংস্থার বিভিন্নকাজের অর্থ তোছরুপের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নিযাম-উল-আযীম বলেন, ‘এটা সঠিক নয়, আগে যেভাবে কাজ চলছিল, এখনো সেভাবেই হচ্ছে। কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নাই।’

স/আর

সর্বশেষ - রাজশাহীর খবর