সহজপ্রাপ্য নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ ডিম

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ডিম একটি সহজপ্রাপ্য নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ। ডিম খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। খাদ্য হিসেবে ডিমের গুরুত্ব বিবেচনায় নিরাপদ ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যে ডিম যে একটি ভালো ও নিরাপদ খাবার, সে বিষয়ে প্রচারণার জন্য, গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্ববাসী ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্ব ডিম দিবস পালন করে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল এগ কনফারেন্সের (আইএসি) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছরের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবস পালনের জন্য নির্ধারিত করা হয়। সে হিসেবে এবারে (২০১৬) অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার হিসেবে ১৪ অক্টোবর বিশ্ব ডিম দিবস পালনের জন্য দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন ও সমিতি দিবসটি পালন উপলক্ষে এর তাৎপর্য তুলে ধরে পৃথক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেখানে ডিমের গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ডিম দিয়ে আধুনিক অনেক রান্নাবান্নার রেসিপি তৈরি করে প্রদর্শন করা হবে। ডিম এমন একটি খাবার, যার অনেক খাদ্যমান ও পুষ্টিমান রয়েছে। ডিমের যে কতশত সহজ রেসিপি রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ডিম দিয়ে কোনো একটি আইটেম রান্না করতে পারে না, এমন কোনো লোক মেলা ভার। কি পুরুষ, কি মহিলা, কি বাচ্চা, কি শিশু-কিশোর—সবাই অন্তত ডিম দিয়ে এর মামলেট, অমলেট, ভাজি, সেদ্ধ করে লবণ-মরিচ দিয়ে ভর্তা করা ইত্যাদি সহজলভ্য আইটেম করতে পারে। ঘরে যদি কিছুই নাও থাকে তারপরও মাত্র নিমেষে মেহমান আপ্যায়ন করার ক্ষেত্রে ডিমের জুড়ি ও বিকল্প নেই।

 

একটি সময় ছিল, যখন গ্রামগঞ্জে, এমনকি শহরের বাড়িতেও তাৎক্ষণিক মেহমান আপ্যায়ন করার জন্য এ বাড়ি-ও বাড়িতে ডিম খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যেত। তাদের আপ্যায়ন করার জন্য প্রতিজনের একটি ডিমই যথেষ্ট ছিল। এখনো ত্বরিত আমিষজাতীয় খাবারের জন্য কিছু কিছু খাবারের সঙ্গে ডিম একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে উল্লেখযোগ্য। যেমন—পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, ভুনা খিচুরি, নুডলস, মোগলাই পরোটা আরো কত কী!।

 

ডিমে খাদ্যোপাদান হিসেবে যে আমিষ রয়েছে, তাতে কোলেস্টেরল রয়েছে। তবে সেই কোলেস্টেরল অন্যান্য প্রাণিজ কোলেস্টেরলের মতো ক্ষতিকর নয়। ডিমের পুষ্টি উপাদান মানুষের শরীরে খুবই সহজপাচ্য, যা অতি সহজেই হজম হয়ে যায়। আর একটি ডিমে কমবেশি মোটামুটি ১০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়। যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সারা দিনের জন্য ২৫০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তির প্রয়োজন হয়। সে জন্য রোগীদের পথ্যের মধ্যে প্রধান আইটেম হলো ডিম। দেখা গেছে, হাসপাতালেও ভর্তিকৃত রোগীদের জন্য প্রতিদিনের এবং প্রতিবেলা খাবারের সঙ্গেই এক বা একাধিক ডিম খাবারের আইটেমে যুক্ত থাকে। কারণ, হাসপাতালে পুষ্টিবিদ এবং ডাক্তারি পরামর্শেই সে খাবার সরবরাহ করা হয়ে থাকে। রোগীদের জন্য ডিম যদি সমস্যাযুক্ত হতো, তাহলে তা নিশ্চয়ই হাসপাতালে সরবরাহ করা হতো না।

 

একসময় গ্রামের বাড়িতে শুধু গৃহপালিত হাঁস-মুরগির ডিমকেই প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাকি অনেক সংখ্যক ডিম প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য গৃহপালিত হাঁস-মুরগির ডিম অপর্যাপ্ত হওয়ায় মানুষ এ চাহিদা পূরণের জন্য বিকল্প খুঁজতে থাকে। সেই চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে উন্নত জাতের হাইব্রিড হাঁস-মুরগি সংকরায়ণ হতে হতে এমন উন্নত হতে লাগল, যেখানে আগে একটি দেশি হাঁস-মুরগি বছরে সর্বোচ্চ মাত্র ১২০ থেকে ১৩০টি ডিম দিত, সেখানে নতুন ও উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি বছরে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিতে শুরু করল। দেশের আনাচে-কানাচে তৈরি হতে লাগল সেসব উন্নত জাতের হাঁস-মুরগির খামার। গত দেড়-দুই দশকে বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পে ব্যাপক উন্নয়ন ও বিপ্লব সাধিত হয়েছে। সে জন্য আমরা মুরগির মাংস ও ডিমে শুধু এখন স্বয়ংসম্পূর্ণই নই, বছরে উদ্বৃত্ত কিছু এখন বিদেশে রপ্তানি করার স্বপ্নও দেখছে বাংলাদেশ। এখন দেশে যেখানেই যাওয়া যায়, সেখানেই পোলট্রি পল্লী গড়ে উঠেছে সেসব জায়গায়। এগুলোর ক্ষেত্রে এক ধরনের বিপ্লব ঘটেছে বলতে হবে। কারণ, এগুলোর মাধ্যমে একদিকে যেমন মাংস ও ডিম উৎপাদন সহজলভ্য হয়েছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক যুব ও আত্মকর্মসস্থান। আর সে কারণেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি অর্থনৈতিক শিল্পায়নের জন্য আজ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারছে।

 

ডিম সহজলভ্য হওয়ায় সবার খাদ্যতালিকাতেই দিনে অন্তত একটি করে ডিম থাকছে, যা দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। যদি এসব শিল্প আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি না ঘটত, তাহলে এখন হয়তো একটি ডিম দুই চোখেও দেখা যেত না। যদিও বা পাওয়া যেত, তবে তার দাম থাকত সবার নাগালের বাইরে। কিন্তু এখন একটি ডিমের মূল্য অন্যসব সমমূল্যের একটি আমিষের দামের চেয়ে অনেক কম। কাজেই ধনী-দরিদ্র সবারই মাংসের স্বাদ দেওয়ার অন্যতম উপাদান এ ডিম উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সবার সহযোগিতা থাকার প্রয়োজন। আর এটিই হলো এবারের বিশ্ব ডিম দিবসের তাৎপর্য।

 

লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: এনটিভি