নওগাঁর ৫৫ ডিলারের মধ্যে ৪৫ জনই টিসিবির পণ্য বিক্রি করে না !

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:
পরিবহণ খরচ বেশি হওয়ার অজুহাতে নওগাঁর ৫৫ জন মধ্যে ৪৫ টিসিবি ডিলারের কোন পণ্য বিক্রি করেননি। জেলা সদরের ৭ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন ডিলার টিসিবি’র পণ্য বিক্রি করেন। টিসিবি’র পণ্য অবিক্রেতা ডিলারদের লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

এদিকে জেলাবাসী জানান, সরকারের নির্ধারিত মূল্যে অর্থাৎ বাজারের চেয়ে অনেক কম মূল্যে পাওয়া যেতো এই পণ্য। এতে বিশেষ করে গরীব শ্রেণির লোকরা তাদের ভোক্ত আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্রেতারা ক্ষোভের সাথে জানান, সরকার স্বল্প মূল্যে যে সব ডিলাররা টিসিবি’র পণ্য বিক্রি করেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

জানা গেছে, ২০০৮ সালে জেলা থেকে কয়েকশ’ ব্যাক্তি টিসিবি’র ডিলার নেয়ার জন্যে আবেদন করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে ৫৫ জনকে লাইসেন্স দেয়া হয়। রাজশাহী থেকে টিসিবি’র পণ্য নিয়ে এসে বিক্রি করে তাদের ব্যাপক লাভও হয়। কিন্তু গত দু’বছর থেকে পরিবহণ খরচ বেশি হওয়ার অজুহাতে জেলার অধিকাংশ ডিলাররা টিসিবি’র পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে জেলা সদরে মাত্র ১২শ’ কেজি চিনি, ১২শ’ লিটার সয়াবিন তেল, ছোল ১২শ’ কেজি এবং মসুর ডাল সাড়ে ৭শ’ কেজি টিসিবি’র পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। বাঁকি ১০ উপজেলার মধ্যে আত্রাইয়ে তিন জন এবং মান্দায় চার জন ডিলার এই সামগ্রী বিক্রি করেন।

সরকারি মূল্য হলো- প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ৮৫ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৫৫ টাকা এবং প্রতি কেজি ছোলা ৭০টাকা।

নওগাঁ শহরের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া (শ্রমিক) সাজু, আমজাদ, লোকমান হোসেনসহ অনেকেই টিসিবি’র পণ্য কিনতে এসেছিলেন মুক্তির মোড়ে। তাদের সাথে কথা হয়। তারা জানান, সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারে চিনি, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল এবং ছোলার দাম বেশি। তাই বাড়ির প্রয়োজনীয় কাজ শেষে এগুলো কিনতে আসেছেন দুপূরে। কিন্তু তাদের আসার আগেই শেষ হয়ে গেছে। না পেয়ে তারা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, রোজার মাসে এসব পণ্য এক কেজি করে পেলেও প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টাকার মতো বেঁচে যেতো।

শহরের চকবাড়িয়ার এনজিও ব্যক্তিত্ব সাহেব আলী জানান, সরকারিভাবে এসব পণ্য আরো বেশি করে বিক্রি করার দাবি জানান। এতে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষদের কিছুটা হলেও টাকা সাশ্রয় হবে।

শহরের চক-এনায়েত দয়ালের মোড়ের কাজী এমদাদুল হক, দেওয়ান আব্দুস সালাম জানান, টিসিবি’র পণ্য বিক্রিতে সরকারের আগে থেকেই কঠোর নজরদারিতে রাখে। এ কারণে ডিলাররা কালোবাজারে বিক্রিতে করতে পারবেন না বলেই অধকাংশ ডিলাররা টিসিবি’র পণ্য উত্তোলন করেননি। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

নওগাঁ সদরের পার-নওগাঁর মেসার্স সানা টেডার্সের প্রোপাইটার শাহাজান আলী সানা জানান, গত বছর মাত্র একবার টিসিবি’র এক টন পণ্য দিয়ে। ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা দিয়ে রাজশাহী থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে নওগাঁয় নিয়ে আসা হয়। ট্রাকের ভাড়া, শ্রমিকের দাম ও রাস্তায় পুলিশের চাঁদাবাজির জন্যে পরিবহণ খরচ বেশি হয়। এছাড়াও টিসিবির পণ্যে ঘাটতি হয়। সব মিলিয়ে এক হাজার টাকার মতো লাভ হয়েছে।

তিনি আরো জানান, টাকার বিষয় বড় নয়; এই সামান্য পরিমাণ পণ্য দিয়ে মানুষের চাপ ও মানষিক ব্যাপক চাপে থাকতে হয়। এ কারণেই এ বছর এই পণ্য তোলা হয়নি। তার মতো অধিকাংশ টিসিবি’র ডিলাররা সরকারি পণ্য বিক্রয়ে আগ্রহী হারিয়ে ফেলেছেন।

নওগাঁ সদরের পার-নওগাঁর মেসার্স নাকিব এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার রহমত আলী জানান, তার শুধু মাত্র দোকান থেকে টিসিবির পণ্য বিক্রয় করার অনুমতি আছে। এক টন পণ্য নিয়ে আসারপর তাদের তেমন লাভ হয় না। এ কারণে এ বছর কোন পন্য উত্তোলন করেননি।

নওগাঁ সদরের মেসার্স নিউ মনছুর টেডার্সের প্রোপাইটার ইউনুস আলী জানান, রাজশাহী থেকে ট্রাকে করে টিসিবি’র পণ্য আনতে হয়। তিন দিনের জন্যে মাত্র ১২শ’ কেজি চিনি, ৩শ’ লিটার সয়াবিন তেল, ছোল ১৮শ’ কেজি এবং মসুর ডাল সাড়ে ৭শ’ কেজি দিয়েছে রাজশাহী টিসিবি অফিস থেকে। এই পণ্য নিয়ে আসতে প্রতি ট্রাকে ভাড়া গুণতে হয় সাড়ে ৬ হাজার টাকা। আর পুলিশ ও বিভিন্ন স্থানে ট্রাক শ্রকিদের বিভিন্ন সংগঠনদের এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বাড়তি এক হাজার টাকা চাঁদা দেয়ায় টিসিবির পণ্য তেমন লাভ থাকে না।

তিনি আরো বলেন, হাজারো মানুষের জন্যে এই সামান্য পরিমাণ পণ্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে ব্যাপক হিমশিম খেতে হয়। পর্যাপ্ত পণ্য দিলে কোন সমস্য হতো না।

নওগাঁ সদরের মেসার্স শাওন টেডার্সের প্রোপাইটার শ্যামল বিশ্বাস জানান, মাত্র ১২শ’ কেজি চিনি, ৩শ’ লিটার সয়াবিন তেল, ছোল ১৮শ’ কেজি এবং মসুর ডাল সাড়ে ৭শ’ কেজি দিয়েছে রাজশাহী টিসিবি’র অফিস থেকে। পুলিশ ও বিভিন্ন স্থানে ট্রাক শ্রমিকদের হয়রানিতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাদের দোকান থেকে এবং ট্রাকে করে এগুলো বিক্রির অনুমতি থাকায় তাদের পরিবহণ খরচ কিছুটা লাঘব হয়। এরপরও প্রতি কেজিতে লাভ হয় মাত্র এক টাকা।

তিনি আরো জানান, এ ভাবে রাস্তায় হয়রানি-চাঁদাবাজি এবং কম লাভ হওয়ায় আগামিতে টিসিবি’র আর কোন পণ্য বিক্রি করবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে নওগাঁয় যদি অফিস স্থাপন করে ডিলারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়; তাহলে তাদের লাভ থাকবে এবং ডিলাররাও টিসিবি’র পণ্য বিক্রয় করতে আগ্রহী হবেন।

টিসিবি’র রাজশাহী অফিসের অফিস প্রধান উপ-উর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতাপ কুমার সংবাদকে জানান, সরকারি এই পণ্যে সাড়ে চার টাকার করে কমিশন দেয়া হয়। ডিলারপ্রতি দেড় টন করে পণ্য দেয়া হয়। এতে পরিবহণ খরচ বাদ দিয়েও প্রতি কেজিতে দেড় টাকার উপর লাভ থাকবে। জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নাটোর থেকে ডিলাররা টিসিবি’র পণ্য তুলে বিক্রি করেছেন। রাজশাহী থেকে জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জে যে দূরত্ব তার চেয়ে নওগাঁর দুরত্ব অনেক কম। এ কারণে নওগাঁর ডিলারদের লাভ না হওয়ার কারণ দেখা যায়না।

তিনি আরো বলেন, নওগাঁর ৫৫ জন মধ্যে ৪৫ টিসিবি ডিলারের কোন পণ্য বিক্রি করেননি। যারা টিসিবি’র পণ্য বিক্রি করেননি তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত ও লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে।

জেলা প্রশাসক ড. আমিনুর রহমান সংবাদকে জানান, এখন পর্যন্ত কোন ডিলার নওগাঁ থেকে টিসিবি’র পণ্য বিতরণের আবেদন করেননি। আবেদন করলে উর্ধ্বতণ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচন করা হবে।

 

স/আ