ঝুঁকি কম, দরিদ্রদের খাবার পৌঁছানোই চ্যালেঞ্জ

করোনার অভিঘাতে সম্ভাব্য খাদ্যসংকট মোকাবেলায় মরিয়া সরকার। যেকোনো মূল্যে খাদ্যের মজুদ বাড়ানো ও দরিদ্র মানুষকে খাবার সরবরাহ করাই এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। সবাইকে ধান ও সব ধরনের শাকসবজি চাষের আহ্বান জানিয়েছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হতে চলেছে। ধান কাটা শুরু হয়েছে। সরকার ২০ লাখ টনের বেশি নিজেই কিনে মজুদ করবে আপত্কালীন সময়ে সরবরাহ করার জন্য। এ ছাড়া আলু, শাকসবজি, তেলবীজসহ বেশির ভাগ পণ্যেই বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে খাদ্যসংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, করোনার কারণে অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবে। তারা কর্মহীন হবে এবং খাদ্যের সরবরাহ থাকলেও তা কেনার সামর্থ্য থাকবে না অনেকের। এ সময়ে দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সহায়তা নিরবচ্ছিন্ন রাখাই হবে সরকারের চ্যালেঞ্জ।

করোনার কারণে বিশ্বজুড়েই মহামন্দার আশঙ্কা করছেন বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, গবেষকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ নিয়মিত পূর্বাভাস দিয়ে জানাচ্ছে যে গভীর মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে সারা বিশ্ব। ইতিমধ্যে আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোতেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যসংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও করোনার প্রভাবে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেশে যাতে খাদ্যসংকট না হয় সে জন্য আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী এক বছরে ধান-চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে প্রায় পৌনে চার কোটি মেট্রিক টন। আর বোরোতে লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি টন। গেল বছরেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্থাৎ পৌনে চার কোটি টন ধান-চাল উৎপাদন হয়েছিল। দেশে বর্তমানে ধান-চালের কোনো ঘাটতি নেই। তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এ বছরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কয়েক লাখ টন বেশি চাল উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। আসছে বোরো মৌসুমেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত দুই লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন হবে বলে জানায় মন্ত্রণালয়টি।

এ মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানায়, হাওরে ১৪ এপ্রিল থেকে ধান কাটা শুরু হয়েছে। সেখানে তিন ধাপে ধান কাটা হবে। ইতিমধ্যে সেখানে প্রায় এক লাখ ২১ হাজার শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছে। হাওরের জন্য ২৪৪টি ধানকাটার যন্ত্র এবং ১৮৬টি হার্ভেস্টার দেওয়া হয়েছে। হাওরে চার লাখ ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধান কাটা হবে। এরই মধ্যে ৮ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে।

এ ব্যপারে কৃষিসচিব মো. নাসিরুজ্জামান  বলেন, ‘আমাদের বোরো, আমন ও আউশে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ফলন হবে। আমরা খবর নিয়েছি, সারা দেশে ধানের বাম্পার ফলন হতে চলেছে। বন্যার আগে আগে ধান কাটা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। সে জন্য আমরা নানা পদক্ষেপও নিয়েছি।’ তিনি জানান, এবার যাতে ধানের বাম্পার ফলন হয় সে জন্য আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সারের দাম কমানো হয়েছে। সেচের অর্ধেক মাসুল কমানো হয়েছে বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা) পক্ষ থেকে।

কৃষিসচিব বলেন, ‘করোনার কারণে দেশে খাদ্যসংকট হবে না। এ রকম কোনো আশঙ্কা করছি না। বাজারে ধান-চালের বিপুল সরবরাহ থাকবে। তবে করোনার কারণে অনেকের কাজ থাকবে না। একটি গোষ্ঠীর হাতে টাকা থাকবে না। ফলে বাজারে চাল থাকলেও তাদের কেনার সামর্থ্য থাকবে না। তাই তারা যাতে চাল কিনতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প উপায়ে তাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাই সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শুধু ধান নয়; আলু, গম, ভুট্টা, শাকসবজি, তেলবীজ, মসলা উৎপাদনেও ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ। অধিদপ্তরের তৈরি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গেল বছরে এক কোটি ১০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এবারের চূড়ান্ত হিসাব হাতে না এলেও, পরিমাণ এর চেয়ে কম হবে না বরং বাড়বে। অর্থাৎ আলু চাহিদার চেয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে। ভোজ্য তেলে বিদেশের ওপর নির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের। ভুট্টারও বাম্পার ফলন হতে চলেছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গেল বছর উৎপাদন হয়েছে ৪৭ লাখ টন।

গত বছর দেশে সরিষা, চীনাবাদাম, তিসি, তিল, সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয় প্রায় ১১ লাখ টন। বিদেশ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টন। রিফাইনারির কারণে আমদানি বেশি হলেও দেশের চাহিদা মিটিয়ে তার একটি অংশ পরে রপ্তানি করা যায়। ভোজ্য তেলে বিদেশের ওপর নির্ভরতা থাকলেও বিশ্ববাজারে এর দাম কমতির দিকে। ফলে এ পণ্যে তেমন সংকটের আশঙ্কা নেই।

গেল বছরে মসুর, ছোলা, মুগ, মাষকলাই, খেসারি, মটর, অড়হরসহ বিভিন্ন ধরনের ডাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টন। কিছুটা বিদেশের ওপর নির্ভরতা থাকলেও এমন নয় যে এর জন্য সংকট হবে।

মসলাজাতীয় পণ্য যেমন পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, মরিচ, আদা, হলুদ ইত্যাদি গত বছর উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ টন। এবারও এর চেয়ে কম হবে না বলে মনে করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গেল বছর পেঁয়াজের দামে নৈরাজ্য হলেও ভারতে ভালো উৎপাদন হয়েছে। আমদানি সহজলভ্য থাকবে আর দেশেও ভালো ফলন হয়েছে। ফলে গেল বছরের মতো নৈরাজ্য হওয়ার আশঙ্কা করছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, করোনার কারণে এ মুহূর্তে পোল্ট্রি, মত্স্য ও ডেইরি খাত কিছুটা ক্ষতির মুখে আছে। পরিবহন সমস্যায় মুরগির দাম পড়ে গেছে। দুধের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় এর দামও কমেছে। তবে সরকারের প্রণোদনার ফলে লকডাউন তুলে দিলে এ খাতগুলো আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। এসব খাতের উৎপাদন দেশের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট। ফলে এসব খাতে সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায, দেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমবেশি প্রায় পাঁচ কোটি। করোনার কারণে নতুন করে অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হবে। ফলে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দরিদ্র মানুষের তখন খাদ্য চাহিদা তৈরি হবে। তাদের কিভাবে খাদ্য চাহিদা পূরণ করা হবে, এ চ্যালেঞ্জ আসবে সরকারের সামনে। সরকারও ইতিমধ্যে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য ৭৫০ কোটি টাকার সহায়তা ঘোষণা করেছেন। সবশেষ এক কোটি মানুষকে নতুন করে রেশন কার্ড করে খাদ্য সহায়তার আওতায় আনার কথাও জানিয়েছেন। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।

পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, এবারও ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছি। বোরোর ফলনও ভালো হয়েছে। এখন এ ফলন ঘরে তুলতে পারলে খাদ্যের কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে চ্যালেঞ্জ হলো, ধান ঘরে তোলা, বাজারে পৌঁছানো এবং কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা। আর করোনার ঝুঁকি থেকে কৃষক শ্রমিককে বাঁচাতে তাঁদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে তাঁরা যাতে সংক্রমণের শিকার না হন সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি বলেন, ‘কৃষিতে বাম্পার ফলন হলেও আরো শক্ত মজুদ গড়ে তুলতে হবে। কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে আমদানি করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে কর বা শুল্ক ছাড় দিতে হবে।’

বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) পভারটি অ্যান্ড সোশ্যাল প্রটেকশন পলিসি অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. মিজানুল হক কাজল বলেন, আপাতত হয়তো খাদ্যসংকট হবে না। তবে ছয় মাসের একটা মজুদ গড়ে তুলতে হবে। আর কৃষিতে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। রিপার মেশিন বা হার্ভেস্টার কৃষককে ভর্তুকি দিয়ে কেনার সুযোগ দিলেও এটা টেকসই হবে না। তা সরকারের হাতে রাখতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করলে ভালো হবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে কর্মহীন মানুষ আরো বিপদে পড়বে যদি লকডাউন দীর্ঘায়িত হয়। তাই তাদের বিশেষ সহায়তা দিতে হবে। বাজারব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ