করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমাদের করণীয়

বিভিন্ন পত্রিকা থেকে জানা যায়, অনেকেই করোনাভাইরাসের ভয়ে ঢাকা ছেড়ে গোপনে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। যার ফলে আতঙ্ক নেমে আসছে সেই এলাকাগুলোতেও। অথচ মহামারির এলাকা থেকে পালিয়ে গিয়েই মহামারির থাবা থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি ওই সব লোকের প্রতি লক্ষ করোনি, যারা সংখ্যায় হাজার হাজার ছিল এবং মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের জনপদ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদের মৃত্যু প্রদান করে আবার তাদের জীবিত করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি বিশেষভাবে অনুগ্রহশীল। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৪৩)

ওই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন তাফসিরের কিতাবে উল্লিখিত বিস্তারিত বিবরণের সারসংক্ষেপ হলো—উক্ত আয়াতে বর্ণিত লোকেরা মধ্য-ইরাকের বাসিন্দা ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত ছিল, সংখ্যায় কমপক্ষে ১০ হাজার ছিল এবং নিজেদের জনপদে মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় এরা মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের জনপদ থেকে পলায়ন করে অন্যত্র গিয়ে অবস্থান করেছিল। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে সেখানেই তাদের মৃত্যু হলো। অথচ তাদের জন্য দুনিয়ার জীবনের নির্ধারিত সময় তখনো শেষ হয়নি। তাই তাদের মৃত্যুর অনেক দিন পর হজরত হিজক্বিল (আ.) নামের নবীর দোয়ায় আল্লাহ আবার তাদের জীবিত করে দিলেন, যাতে বিশেষভাবে তারা এবং ব্যাপকভাবে সব লোক এ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যে মহামারি থেকে পলায়ন করা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার গ্যারান্টি নয়। বরং আল্লাহ যার ভাগ্যে যখন যেভাবে মরণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তাকে তখন সেভাবেই মরতে হবে। এটাই ‘তাকদিরে বিশ্বাস’। এ বিশ্বাস যাদের নেই, তাদের ঈমান নেই।

এর সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ থাকা আবশ্যক যে ওষুধের মধ্যে আল্লাহ যেভাবে রোগ নিরাময়ের উপাদান দিয়ে রেখেছেন বলে তা ব্যবহার করা মানুষের দায়িত্ব। কিন্তু ওষুধ কার্যকর হওয়া না হওয়া সম্পূর্ণই আল্লাহর হুকুমের ওপর নির্ভরশীল। তেমনিভাবে মহামারি রোগের মধ্যেও আল্লাহ সংক্রমণের উপাদান দিয়ে রেখেছেন বলেই তা থেকে সতর্ক থাকা মানুষের দায়িত্ব। কিন্তু পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বনের পরও মহামারি থেকে মুক্ত থাকা না থাকা সম্পূর্ণভাবেই আল্লাহর হুকুমের ওপর নির্ভরশীল। এ মৌলিক বিশ্বাস সব মুসলমানের অন্তরে বদ্ধমূল থাকা দরকার।

মুসলমানদের উপরোক্ত মৌলিক বিশ্বাসের আলোকেই আমরা মহামারিসংক্রান্ত হাদিসগুলোকেও অনায়াসেই বুঝে নিতে পারি। বুখারি, মুসলিম ও আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত এক হাদিসে উটের সংক্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে রাসুল (সা.) বলেন—বলো তো সর্বপ্রথম আক্রান্ত উটের পাঁচড়া কোত্থেকে এলো? এর মর্ম হলো, আল্লাহ যদি কাউকে মহামারিতে আক্রান্ত করাতে চান, তাহলে সে কোনো মহামারিতে আক্রান্তদের সংস্পর্শে না গেলেও আক্রান্ত হবেই।

পক্ষান্তরে বুখারি, বায়হাকি ও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, কুষ্ঠরোগী থেকে এমনভাবে পলায়ন করো, যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করে থাকো। স্থূল দৃষ্টিতে এ হাদিস পূর্বোক্ত হাদিসের পরিপন্থী বলে মনে হতে পারে! কিন্তু আসলে উভয় হাদিস যথাস্থানে প্রযোজ্য। কারণ মহামারিতে আক্রান্ত হওয়া না হওয়া আল্লাহর হুকুমের অধীনে হলেও আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব। উল্লিখিত উভয় হাদিসের মর্ম বুখারির বর্ণিত আরেকটি হাদিসে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ধরনের মহামারির ব্যথা সম্পর্কে আলোচনা করে বললেন, এটা আল্লাহর আজাব। এর মাধ্যমে আল্লাহ পূর্ববর্তী উম্মতদের শাস্তি দিয়েছেন। বর্তমানেও এর কিছুটা রয়ে গেছে। যা মাঝেমধ্যে প্রকাশ পায়, আবার মাঝেমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কাজেই কেউ যদি কোনো এলাকায় এ মহামারির সংবাদ পায়, তাহলে সে যেন সেখানে না যায়। আর যার এলাকায় মহামারিটি প্রকাশ পায়, সে যেন সেখান থেকে পালিয়ে না যায়। (বুখারি, হাদিস : ৬৯৭৪)

উভয় হাদিসের বিবরণের সামঞ্জস্য

এর মর্ম হলো, অন্য এলাকায় মহামারি দেখা দিলে বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখানে না গিয়ে ছোঁয়াচ থেকে দূরে থাকা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু নিজ এলাকায় মহামারি দেখা দিলে অন্য কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া তাকদিরের প্রতি ঈমানের পরিপন্থী। এ ছাড়া মহামারিতে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবাদানের পরিবর্তে তাদের অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যাওয়া যে মানবতারও পরিপন্থী, তা কোনো বিবেকবানকে খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্যই রাসুল (সা.) বলেছেন, এদের থেকে পলায়ন করে যেয়ো না। আর তখনই প্রয়োজন হয় তাকদিরের প্রতি অটল বিশ্বাসের। আল্লাহ যদি আমার ভাগ্যে মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ লিখে রাখেন, তাহলে আমি পলায়ন করে অন্যত্র চলে গেলেও তা থেকে রক্ষা পাব না; যেভাবে পূর্বোক্ত আয়াতে বর্ণিতরা রক্ষা পায়নি। আর যদি আক্রান্ত হওয়া আমার অদৃষ্টে লেখা না থাকে, তাহলে আমি এদের কাছে থাকলেও আক্রান্ত হব না। এ বিশ্বাসের সুফল অনেক। প্রথমত, এতে আমার ঈমান সংরক্ষিত থাকে। দ্বিতীয়ত, মানবতা রক্ষা হয়। তৃতীয়ত, আক্রান্তরা সেবাযত্ন থেকে বঞ্চিত হয় না।

তবে হ্যাঁ, অকারণে আক্রান্ত এলাকায় যেতেও রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ওমর (রা.)-এর সিরিয়ার সফর বাতিল করার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি একবার কিছু সঙ্গী-সাথি নিয়ে সিরিয়া সফরে যাত্রা করে রাস্তায় খবর পেলেন যে সেখানে মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তাই রাসুলের ওই হাদিসের ভিত্তিতে তিনি সিরিয়ার সফর বাতিল করে মদিনায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন সিরিয়ার গভর্নর সাহাবি আবু উবায়দা (রা.) ওমর (রা.)-কে প্রশ্ন করেছিলেন যে ‘আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন করতে চান?’ উত্তরে ওমর (রা.) বলেন—হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন করে আবার সেই তাকদিরের দিকেই ফিরে যেতে চাই। (তাফসিরে কুরতুবি : ৩/১৫২ থেকে সংক্ষেপিত)

হজরত ওমর (রা.)-এর উক্তির ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবির একই পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে যে আল্লাহ মানুষের তাকদিরে যতটুকু মঙ্গল-অমঙ্গল লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তা খণ্ডানোর সাধ্য তো কারো নেই; কিন্তু আল্লাহ আমাদের ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং অপ্রীতিকর বিষয়গুলো থেকে সাধ্যমতো বেঁচে থাকার আদেশ করেছেন। এর মর্ম হলো, তাকদিরে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তা তো আক্রান্ত স্থানে গেলেও হবে, না গেলেও হবে। কিন্তু আত্মরক্ষার উপায় বা সতর্কতা অবলম্বন করা আমাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই রাসুল (সা.) আক্রান্ত স্থানে অকারণে যেতে নিষেধ করেছেন। এর দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হলো যে বাহ্যিক সতর্কতা অবলম্বন করাও দরকার।

তাই আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি, আমাদের উচিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনাগুলো মেনে চলা এবং মহান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা করা। কারণ মহান আল্লাহ ছাড়া উদ্ভূত এ পরিস্থিতি থেকে কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। অন্যদিকে যাঁরা চিকিৎসাসেবার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের উচিত সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে দায়িত্ব পালন করা। কারণ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে গেলেই করোনা থেকে মুক্ত থাকার কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে সতর্কতা অবলম্বন করে মানবতার খেদমতে থাকলে মহান আল্লাহ এর উত্তম প্রতিদান অবশ্যই দেবেন।

 

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ