আত্মহত্যার আড়ালে হত্যা

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:   আত্মহত্যার ৭৩টি ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের তদন্তে জানা গেছে, পুলিশ ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাগুলোকে আত্মহত্যা বলা হলেও, সেগুলো ছিল আসলে হত্যাকান্ড।

২০১৬ সাল থেকে তদন্ত করে ওই সব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হয়। এখনো পিবিআই ও সিআইডিতে তদন্তাধীন আছে দুই শতাধিক মামলা।অপমৃত্যু হিসেবে ওই মামলাগুলো হয়েছে ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রংপুরসহ অন্তত ৪২টি জেলায়।

তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের লেনদেন, তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি ও পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে প্রায় প্রতিটি ঘটনায়।আকস্মিকভাবে মৃত্যু, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আত্মহত্যা বা সন্দেহজনক মৃত্যুর ক্ষেত্রে থানায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারায় যে মামলা করা হয় তাকে অপমৃত্যৃর মামলা বা ইউডি (আননেচারাল ডেথ) মামলা বলে।পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৩৩টি থানায় গড়ে প্রতি মাসে অন্তত ৩০টি অপমৃত্যুর মামলা হয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে রাজশাহীর বোয়ালমারীতে হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে সুমাইয়া নাসরিন ও তার বন্ধু মিজানুর রহমানের লাশ উদ্ধার করা হয়। মিজানুরের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। আর সুমাইয়ার লাশ বিছানায় বালিশচাপা দেওয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। তাদের মরদেহ ময়নাতদন্ত করে আত্মহত্যার প্রতিবেদন দেওয়া হয়। থানা পুলিশ ‘কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়’ ময়নাতদন্তের ওপর ‘ভিত্তি করেই’ আদালতে আত্মহত্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেয়। কিন্তু থানা পুলিশের প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট না হয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়।

এরপর পিবিআইয়ের তদন্ত দল বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয় দুজনকেই হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় সুমাইয়ার বন্ধু আল আমিন, বোরহানুল কবির, আহসান হাবিব ও রাহাত মাহমুদকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, হত্যার কারণ ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক। হত্যাকান্ডের আগে রাহাত ও আল আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে। পরে মিজানকে হত্যা করে তার লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে।

২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রামপুরা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোনায়েমকে হত্যা করা হয়। খুনের পর তার মরদেহ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয় আত্মহত্যা। পুলিশ তা আমলে নিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে বাদীর নারাজিতে তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্তে বেরিয়ে আসে মোনায়েমকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়।

নুরুল ইসলাম ওরফে নুরের বাড়ি টাঈাইলে। তিনি বসবাস করতেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচির মধুপুর এলাকায়। ২০১৮ সালের ২৮ জুন ওই এলাকার একটি বাড়ির পাশের জমিতে তার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায়ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় আত্মহত্যা বলে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আলীম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে ওই গ্রামের ওমর ফারুক, তার বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমা বেগমকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরে মামলার বাদী নূর ইসলামের স্ত্রী মনো বেগম নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।

পিবিআই ১৭ সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়ে হত্যাকা-ের ধারণা পায়। গত বছরের এপ্রিলে ফারুক আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক জানান, পরিচয়ের একপর্যায়ে তাকে টাঙ্গাইলের একটি তাঁতকলে চাকরি দেন নূর ইসলাম। সেখানে কাজ করার একপর্যায়ে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন নূর ইসলাম। অতিষ্ঠ হয়ে তিনি বাড়ি চলে আসেন। নূর ইসলামও তাদের বাড়ি আসেন। নূর ইসলামের যৌন হয়রানিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ২৭ জুন রাতে তিনি তাকে গলা টিপে হত্যা করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক আরও জানান, নূর ইসলামের লাশ তিনি বাড়ির উঠানে বরইগাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি রাতেই তার মা-বাবা টের পান এবং তাকে মারধর করেন। পরে ফারুক সব খুলে বললে তারা লাশটি পরিত্যক্ত স্থানে ফেলে দেন।

এ ঘটনায় লাশ গুমে সহায়তার অভিযোগে ফারুকের বাবা-মাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।মামলার বাদী মনো বেগম টেলিফোনে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘থানায় মামলা করলেও পুলিশ কোনো ধরনের সহায়তা করেনি। পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি।’

বেলকুচি থানায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আব্দুল আলীম অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন।তবে পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কামরুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, মামলাটি নতুন তদন্ত করতে গিয়ে অনেক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। তদন্তের প্রথম থেকেই প্রশ্ন জাগে বিষয়টি কিছুতেই অপমৃত্যু হতে পারে না।

গত বছরের ৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মণদী ইউনিয়নের চাষপাড়া এলাকা থেকে করিম নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্ত ও থানা পুলিশের তদন্তে বলা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরে সিআইডি ছায়া তদন্ত করে নিশ্চিত হয় যে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

বছর দেড়েক আগে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পূর্বপাড়ার মদিনা মসজিদের পাশে মুক্তা বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়। কিন্তু সিআইডি তদন্ত করে জেনেছে ঘটনাটি হত্যাকা-। পারিবারিক বিরোধের জের ধরে স্বামী সোহাগ তাকে হত্যা করেন। ঘাতক সোহাগকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

বগুড়ার সোনাতলা তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চরসারুলিয়া এলাকা থেকে উদ্ধার হয় হাছান আকন্দ নামে এক ব্যক্তির লাশ। নিহতের স্ত্রী আঙ্গুর বেগম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। পুলিশি তদন্ত ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, হাছান আত্মহত্যা করেছেন। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ছায়া তদন্ত করে নিশ্চিত হয় যে ওই ব্যবসায়ী টাকা লেনদেনের বিরোধে খুন হয়েছেন।

এসব ঘটনার মতো মোট ৭৩টি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই ও সিআইডি। এর মধ্যে ২৪টি মামলা তদন্ত করেছে পিবিআই। বাকিগুলো করেছে সিআইডি।

সিআইডির এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত তিন বছরে সিআইডি ৪৯টি অপমৃত্যু মামলার বিষয়ে তদন্ত করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, ময়নাতদন্ত ও থানা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা অনৈতিক কাজেও জড়িত ছিলেন। আবার থানার কর্মকর্তারা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। এ রকম আরও কিছু মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।

সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান  বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশেই সব মামলা নিয়ে সিআইডি কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অপমৃত্যু ও ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। আগে অপমৃত্যু মামলা হয়েছে পরে আমরা তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছি, আসলে হত্যাকান্ড হয়েছে। এ রকম বেশ কিছু ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে।’

একই কথা বলেছেন পিবিআইর প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি  বলেন, তিন বছরে এ ধরনের ২৪টি মামলার তদন্ত করে হত্যাকান্ডের প্রমাণ পেয়েছেন তারা। তদন্তের সময় দেখা গেছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলে চিকিৎসক বা তদন্ত কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। আসলে ঘটনা ছিল ভিন্ন।

বনজ কুমার বলেন, ‘মর্গে যারা কাজ করেন সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে। তা ছাড়া থানা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারও গাফিলতি আছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। এসব ঘটনায় কোনো অনৈতিক কর্মকা- হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যারা এসবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা  বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ আছে যে মামলার তদন্ত করতে বাদী বা আসামির কাছে টাকা দাবি করেন। কেউ টাকা দিতে না পারলে তার বিরুদ্ধেই প্রতিবেদন দেওয়া হয়; বিশেষ করে সাধারণ ডায়েরি ও অপমৃত্যু মামলা নিয়েই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বেশি।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের কোনো সদস্য তদন্তের নামে অপকর্ম করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারও ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।

অপরাধ বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঘটনাগুলো দুঃখজনক। হত্যাকা-গুলো কেন অপমৃত্যু মামলা হয় তা বোধগম্য নয়। এতে প্রমাণ হয়, ময়নাতদন্ত ও থানা পুলিশের তদন্তে গাফিলতি আছে। আবার অনৈতিক বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। এসবের বিষয়ে গভীরে গিয়ে তদন্ত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিবিআই ও সিআইডি যেভাবে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছে, তা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তাদের মতো পুলিশের সব কটি সংস্থার ওপর সবার আস্থা রাখতে পুুলিশের ঊর্ধ্বতনরা কাজ করবেন বলে আশা করছি। পাশাপাশি বিশে^র বিভিন্ন দেশের মতো হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত করতে আলাদাভাবে একটি ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলা উচিত।’

এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রশীদ বলেন, ‘মেডিকেল কলেজের মর্গগুলোতে প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগ দিতে হবে। ভুল প্রতিবেদন দিলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’

ময়নাতদন্ত বিষয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি নির্ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে। ভুল হওয়ার কথা না। তবে জেলা শহরগুলোতে নানা সমস্যা হয়। কারণ জেলায় ভিসেরা সংরক্ষণ করে তা দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া হয়। লম্বা সময়ে অনেকগুলো ঘটনা জমা হলে তা ফরেনসিকে পাঠানো হয়। এতে অনেক সময় নির্ভুল প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয় না।’ পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

সূত্র: দেশ রুপান্তর