রাজশাহীতে শিল্প-কারখানায় সংযোগ বন্ধ: গোপনে গ্যাস দেওয়া হলো সিএনজি স্টেশনে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীতে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সংযোগ প্রদান বন্ধ থাকলেও ৬ বছর আগে অনুমোদন পাওয়া একটি সিএনজি স্টেশনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সোমবার অনেকটা গোপনে এ সংযোগ দেন পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানীর রাজশাহী অফিস। এ নিয়ে রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

 

নগরীর খঢ়খড়ি কচুয়াতৈল এলাকায় অবস্থিত নতুন ওই সেএনজি স্টেশনটি হলো বিতর্কিত সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক’র ভাই নাজমুল হকের। এ কারণেই সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গতকাল গোপনে সিএনজি খাতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

 

  • যেখানে ঘন্টায় ৬০০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহৃত হবে গাড়ীর জ্বালানী হিসেবে। অথচ রাজশাহীর শিল্পখাতে গ্যাসের সংযোগ চেয়ে আবেদন করে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করেও এখনো সংযোগ পাননি এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা অন্তত ৭ জন। গ্যাসসংযোগ না পেয়ে তাঁদের উৎপাদনমূখী কারখানা চালু করতে পারছেন না এখনো।

01
পশ্চিামাঞ্চল গ্যাস কম্পানীর রাজশাহী কার্যালয় সূত্র মতে, ‘সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০১৩ সালের শেষের দিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর ভাই নজমুল হক এবং ভাগ্নে ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) সিরাজুল ইসলাম বাবুর নামে রাজশাহী নগরীর খড়খড়ি এলাকায় (আমচত্তর-বেলপুকুর বাইপাশের দক্ষিণ পাশে) অবস্থিত এনবি ফিলিং স্টেশনকে সিএনজি স্টেশনের জন্য অনুমোদন নিয়ে দেন। কিন্তু বিগত নির্বাচনে এনামুল নিজ থেকেই সরে দাঁড়ানোর পরে ওই সিএনজি স্টেশন চালু নিয়ে জটিলতা দেদখা দেয়। তবে সম্প্রতি আবারো নগরীর খড়খড়ি এলাকায় নতুন নির্মাণ করা সেই সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের সংযোগ দিতে তড়িঘড়ি শুরু করে রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানী।

 

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার অনেকটা গোপনে কাউকে কিছু না জানিয়ে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানী ওই সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের সংযোগ দেন। অথচ সারা দেশে অউৎপাদনশীল খাতে গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে গোপনে সরকারের অন্য কোনো সংস্থাকে না জানিয়ে গতকাল ওই সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়।

 

  • জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানীর রাজশাহীর ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এনবি সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সংযোগের ফাইলপত্র অনেক আগ থেকেই অনুমদোন ছিল। এ কারণে কাউকে কিছু জানানো হয়নি। আগে অনুমোদিত থাকায় আজ (গতকাল) সেখানে সংযোগ দেওয়ার কাজ করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ তারা সিএনজি স্টেশনটি চালু করবে, সেটা তাদের বিষয়।’

 

02
কোনো চাপেরমুখে ওই সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়নি দাবি করে রফিকুল ইসলাম আরো বলেন, ‘কম্পানী থেকে সকল কাগজপত্র অনুমোদন থাকায় সেখানে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।’
তাহলে টাকা জমা নেওয়ার পরেও এমনকি সকল কাজপত্র অনুমোদন থাকায় অন্য ৭টি শিল্প কারখানায় কেন গ্যাসের সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি আমার সিদ্ধান্ত নয়, কম্পানীর সিদ্ধান্ত।’
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানীর আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের মালিকানাধিন স্টেশনকে অনুমতি দিতে আমরা শুধু সুপারিশ করেছি মাত্র। বাকি কাজ করেছে গ্যাস সংযোগ কমিটি। ওই কমিটিই সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের ভাইয়ের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সিএনজি স্টেশনের অনুমতি দিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাসসংযোগ কমিটির নিকট থেকে অনুমতি পাওয়ার পরেও ওই প্রতিষ্ঠানকে ১৩টি ধাপে বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে বলা হয়। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরেই আমরা সেখানে সিএনজি গ্যাসের সংযোগ দিয়েছিল। ২০১১ সালে ওই সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার অনুমোদন লাভ করে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

047

  • পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানী সূত্র মতে, ২০১৩ সালের ৭ জুন রাজশাহীতে বাসাবাড়িতে গ্যাসসংযোগ উদ্বোধন করা হয়। এরও প্রায় বছর দুয়েক আগে অর্থাৎ ২০০১১ সালে নগরীতে সিএনজি স্টেশনের জন্য আবেদনপত্র নেওয়া হয়। ওই সময় ৮ জন পেট্রল পাম্প মালিক সিএনজি স্টেশনের জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের ভাই নজমুল হক ও তাঁর ভাগ্নে সিরাজুল হক বিপ্লবের মালিকানাধিন নগরীল খড়খড়ি এলাকায় ‘এনবি ফিলিং স্টেশন’কে সিএনজি স্টেশনের জন্য অনুমতি দেয় পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানী।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের ভাই নজমুল হক ও ভাগ্নে সিরাজুল হক বিপ্লব জমি কিনে ওই ফিলিং স্টেশনটি স্থাপন করেন। এরপর তাঁদের নামের একটি করে করে আধাক্ষর দিয়ে এনবি ফিলিং স্টেশন নামকরণ করেন।
রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানীর আরেকটি সূত্র জানায়, রাজশাহীতে বাসা-বাড়ির জন্য প্রায় ২১ হাজার আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার গ্রাহককে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। অন্যদিকে শিল্প কারখানার জন্য আবেদন জমা পড়ে মোট ১৪টি।

 

  • এর মধ্যে সাতটি কারখানায় সংযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু আরো সাতটিতে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরও এখনো সংযোগ মেলেনি। এর অন্যতম কারণ হলো নতুন করে সব ধরনের গ্যাসসংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে নগরীর খড়খড়িতে নির্মিত সিএনজি স্টেশনের জন্য গ্যাস সংযোগ দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যাচ্ছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পান। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে রাজশাহী শিল্প উদ্যোক্তাদের মাঝে।

রাজশাহীর একজন শিল্প উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিল্প-কারাখানায় গ্যাসসংযোগ দেওয়া হলে অনাগ্রসর রাজশাহীকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে গ্যাস কম্পানী যানবাহনের জন্য গ্যাস অপচয় করতে সিএনজি স্টেশনে সংযোগ দিয়েছে। এটি রাজশাহীর জন্য বড় ধরনের ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত বলেও দাবি করেন ওই ব্যবসায়ী।
রাজশাহী শিল্প  ও বণিক সমিতির সভাপতি মনিরুজ্জামান বলেন, সরকার যে মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়ে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রাজশাহীতে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্যাস সরবরাহ নেটওয়ার্ক নির্মাণ করেছিল, এখন তা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কারণ রাজশাহীতে শিল্পখাতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না।

 

  • এদিকে সোমবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কম্পানী রাজশাহী অফিসের ইনচার্জ রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে এনবি ফিলিং স্টেশনে সিএনজি গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার কাজ চলছে। জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাতের মধ্যেই কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাবে। এরপর সিএনজি স্টেশন কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছেমতো যাবানহনে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে।

03
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সিএনজি স্টেশনের মালিক নাজমুল হক ও ভাগ্নে সিরাজুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের ম্যানেজার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকদিন আগেই আমরা আদেন করে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করেছি। তারই ধারাবহিকতায় আজ সংযোগ পেলাম। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে পরে চালু করবো। স্টেশনের আরো কিছু বাকি আছে, এগুলো শেষ করেই সিএনজি স্টেশনটি চালু করা হবে।’
তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সংযোগ দেওয়ার পরপরই িিসএনজি স্টেশনটি চালু করা হলে মিডিয়ায় লেখালেখি হবে-এমন আশঙ্কায় এখনোই চালু করা হচ্ছে না স্টেশনটি। কিছুদিন পরে পস্থিতি স্বাভাবিক হলেই স্টেশনটি চালু করা হবে।
স/আর