গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই বলেই!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এই লেখা পর্যন্ত যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে খাদিজা এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগমকে কলেজের অভ্যন্তরেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা বদরুল আলম। দূর থেকে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় কেউ এই নির্মম আক্রমণের দৃশ্য ধারণ করেছেন। কিন্তু কাছ থেকে কেউ আক্রমণকারীকে ঠেকাতে যাননি। কেউ এগিয়ে যাননি আক্রমণকারীর হাত থেকে খাদিজাকে রক্ষা করতে। আমরা ছবিতে দেখেছি চাপাতি দিয়ে আঘাতের নৃশংস দৃশ্যটি। আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। ঘৃণা ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে আমাদের মন; ভরে ওঠে দুঃখ-বেদনায়। আমাদের সমাজ অধঃপতনের কোন নিম্ন সীমায় এসে পৌঁছেছে!

 
আমরা সবাই ব্যথিত। সবার মতোই ব্যথিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। তিনি আরও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কেউ মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে গেল না। কেন মানবিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে গেল?’ প্রধানমন্ত্রীর মর্মবেদনার সঙ্গে আমরা সবাই একাত্ম বোধ করি। আমাদেরও একই প্রশ্ন—দূর থেকে ছবি তোলা গেল, কিন্তু মেয়েটিকে রক্ষা করতে কারও পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না? ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর এই আক্ষেপযুক্ত বক্তব্যটি ছাপা হয়েছিল। একই দিনের উপসম্পাদকীয়তে সাহিত্যিক আনিসুল হকেরও লেখা একটি কলাম ছাপা হয়েছিল। তিনিও প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, ‘ছবি তুলব, নাকি মানুষ বাঁচাব?’ এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন, ‘সবকিছুর ওপরে মানবতা। বিপন্নকে যদি বাঁচানো যায়, তাহলে ছবি না তুলে প্রথমে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত।’

 

 

আমার মনে হয়, আমরা এখনো অতটা মানবতাশূন্য হয়ে পড়িনি। আনিসুল হকও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এখনো একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসে।’ সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এ রকম অনেক উদাহরণও তিনি দিয়েছেন। তাহলে খাদিজাকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে গেল না কেন? প্রথমত, আক্রমণকারী অনেক ক্ষমতাবান। তিনি ছাত্রলীগের নেতা। দ্বিতীয়ত, তিনি সশস্ত্র ছিলেন। মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন হারানোর ঝুঁকি খুব কম মানুষই নিতে পারে।

আমি মনে করি, আমরা এখনো মানবতাবোধশূন্য হয়ে পড়িনি। রানা প্লাজার ঘটনার সময় দেখেছি, কীভাবে মানুষ একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। বাঙালির দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে এই মানবতাবোধ। এই সহমর্মিতাবোধ। তবু কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা দ্বারা যে সাময়িকভাবে আমরা আক্রান্ত হয়েছি, এটাও সত্য। তবে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা আমাদের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সরল জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। এবং সেটাও সাময়িক সময়ের জন্য।

বাঙালি সমাজের স্বাভাবিক ও সহজাত যে বৈশিষ্ট্য, তা আরও বিকশিত হবে নাকি অধঃপতিত হবে, তা অবশ্য বহুলাংশে নির্ভর করে বাইরের কিছু উপাদানের ওপর। রাজনৈতিক আদর্শবোধ যখন প্রবল থাকে, যেমনটা ছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে; তখন ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতাবোধও উচ্চপর্যায়ে বিকশিত স্তরে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবেশ যদি কলুষিত থাকে, তাহলে তা সমাজের ভেতরে ক্ষয়রোগের মতো জীবাণুর বিস্তার ঘটায়।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বছর আমরা পরপর কয়েকটা শিশু নির্যাতনের ঘটনা দেখেছি। নির্যাতনের যে নৃশংসতা, বর্বরতা ও অশ্লীলতা তা আমাদের স্বাভাবিক মানসিক গড়নের সঙ্গে মোটেও খাপ খায় না। কিন্তু কেন এমন হলো? এর কারণও রাজনৈতিক, যদিও শিশু নির্যাতনের কোনোটির সঙ্গেই রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। নির্যাতনকারীরাও কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ নয়। তবু কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রহীনতার পরিবেশ কিছু বিকৃত মানসিকতার লোককে এমন জঘন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে। গত বছরের আগস্ট মাসে মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান যথার্থই বলেছিলেন, ‘আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণেই শিশু নির্যাতন।’

পরিবেশটা যদি এমন হয় যে অপরাধ করলেও পার পাওয়া যায়, আর ক্ষমতাবানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলে যা খুশি তা-ই করা যায়, তাহলে এমন ধারণা সংক্রমিত হবে সর্বত্র। যারা ক্ষমতাবলয়ের বাইরে, তাদেরও কেউ কেউ ভাবতে পারে যে অপরাধ করলে কিছুই হবে না। হয়নি তো তনু হত্যার বিচার। হয়নি ত্বকী হত্যার বিচার। আর সরকারদলীয় ছাত্র–যুব সংগঠনের উঠতি মাস্তানেরা তো ভাবতেই পারে, আমাদের ধরবে কে, রুখবে কে?

চোখের সামনে উদাহরণও অনেক আছে। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে গোলাগুলি ও নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা তো কম ঘটেনি। খাদিজার ঘটনা যেমন প্রধানমন্ত্রীর কাম্য ছিল না, তেমনি ছাত্রলীগ-যুবলীগের খুনোখুনির ঘটনাও নিশ্চয়ই তিনি চান না। কিন্তু ঘটনা তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারণ, রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব থাকলে, গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলে তা অন্যান্য ক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করবে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের তরুণ মাস্তানদের মধ্যে সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাক্স দখল ও নারী দখলের প্রবণতা প্রচণ্ডতা লাভ করবে। সব দেশের সব কালের অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে।

খাদিজার ঘাতক ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা হলেও ঘটনাটি রাজনৈতিক ছিল না। কিন্তু সেই ঘাতক তো ভাবতে পারেন যে যেহেতু তিনি ক্ষমতাসীন দলের কেউ, তাই তাঁকে কেউ কিছু করতে পারবে না, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে অন্য কেউ হলে হয়তো অপরাধের শাস্তির ভয় থাকত, যা তার প্রতিহিংসাকে কিছুটা হলেও দমন করতে পারত।

প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, ‘কেউ কেন মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে এল না!’ আসবে কী করে? কাছাকাছি যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জানতেন যে চাপাতি হাতে যে লোকটি আক্রমণ চালাচ্ছেন, তিনি সাধারণ কেউ নন, ক্ষমতাসীনদেরই একজন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে যাননি। কিন্তু পরে জনতা ধাওয়া করেছে এবং এখন বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে সিলেটসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ।

তাৎক্ষণিকভাবে কেন কেউ সাহস করল না, আর পরে সমষ্টিগতভাবে কেন মানুষ সাহস দেখাতে পারল—এই দুটি দিকই আমাদের চিন্তার মধ্যে আনতে হবে।

ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ বা স্থানীয় নেতাদের একাংশের অনেক অনাচার মানুষ সহ্য করে। কারণ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। তাই দেখি, গাইবান্ধার এক সাংসদ ১২ বছরের এক বালকের পায়ে গুলি চালিয়েও বহাল তবিয়তে এলাকায় দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করেন। মানুষ এসব দেখে। ফলে একধরনের আতঙ্ক কাজ করে। আবার সুযোগ পেলে সেই মানুষই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। একই মানুষ কখনো ভীত, কখনো সাহসী। সবটাই নির্ভর করে চারপাশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর।

আমাদের দেশে এখন কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। তার কারণও আছে। দেশে কার্যকর শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। প্রধান প্রতিপক্ষ দল বিএনপি এখন ছত্রভঙ্গ, ভঙ্গুর ও দিকনির্দেশনাহীন। মানুষ বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করে ফেলেছে। বিএনপির অনেক নেতার ওপর যে অনেক অন্যায়-অত্যাচার হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু অন্যায়-অত্যাচার রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বিএনপি হারিয়ে ফেলেছে। তারা গণতন্ত্রের ডাক দিচ্ছে, কিন্তু সেই ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। না রাস্তার জনগণ, না কোনো রাজনৈতিক দল। তারা আলোচনা করতে চেয়েছিল সরকারের বাইরের দলগুলোর সঙ্গে। তাদের জোটভুক্ত দলগুলোর বাইরে কোনো একটি দলের কাছ থেকেও সাড়া পায়নি।

সাধারণ মানুষও বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল বলে ভাবতে পারে না। এটা যেন মা ও ছেলের ক্লাব। তাঁরা গণতন্ত্রের কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যার নিন্দা করেন। নিন্দা আমরাও করি। কিন্তু বিএনপি তো একবারও তার আমলে সংঘটিত ক্রসফায়ার, অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে বিচারবহির্ভূত পন্থায় সন্দেভাজন অপরাধীদের প্রাণনাশের জন্য আত্মসমালোচনা করে জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। ভুল স্বীকার ও ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার রীতি আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সংস্কৃতির মধ্যে নেই। বিএনপি আরও যে বড় অপরাধটি করেছিল তা হলো, অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় যারা নির্যাতন চালিয়েছিল অথবা হত্যা করেছিল, তাদের দায়মুক্তি দিয়েছিল পার্লামেন্টে আইন পাস করে। কোন মুখে তারা আজ গণতন্ত্রের দাবি তোলে?

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে এখনো অন্য কোনো শক্তিশালী দল নেই। সরকারের বাইরে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বিরোধী দল থাকা শুধু গণতন্ত্রের জন্যই জরুরি নয়, সামাজিক ভারসাম্য ও সুস্থ সামাজিক পরিবেশের জন্যও প্রয়োজনীয়। যে নৈতিক অধঃপতন আমরা লক্ষ করছি, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কোনো শক্তিশালী দল থাকলে তা এতটা হতে পারত না। বিশেষ করে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির উপস্থিতি খুবই জরুরি বলে মনে হচ্ছে।

হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।

সূত্র: প্রথম আলো