৩০ ঘন্টা পথ গাড়িতে পাড়ি, পোল্যান্ডে পৌঁছাতে আরও ৭৩ কি.মি. হাঁটতে হচ্ছে


রফিকুল ইসলাম:

আজাহার মাহাবুব মাসখানেক আগে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের কিয়েভ শহরে পড়াশোনার জন্য। বাংলাদেশের চাঁদপুরের  এ যুবক একবুক স্বপ্ন সিয়ে সুদূর ইউক্রেন পাড়ি দিয়েছিলেন। আশাছিলো উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরবেন অথবা ইউরোপের কোনো দেশে চাকরি নিয়ে উন্নত জীবন গড়বেন। সেই মাহবুবের চোখে মুখে এখন যেন একরাশ আতঙ্ক আর অন্ধকার নেমে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর হামলা শুরু হওয়ার পর উচ্চতর ডিগ্রির আশা ছেড়ে মাহাবুব এখন জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারবেন কিনা সেই আতঙ্কে রয়েছেন। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে কিয়েভে একের পর এক রাশিয়ান বাহিনী বোমা বিস্ফোরণ শুরু করার পর থেকে মাহবুব জীবন বাঁচাতে ভাড়া করা গাড়ীতে ছুটতে থাকেন পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে। পোল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন মাহবুবসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী ও কিয়েভের সাধারণ মানুষও। বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটার দিকে মাহবুব রওনা দেন পোল্যান্ডের সীমান্তের উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি পৌছান ইউক্রেনের লাভিভ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে।

মাহবুব জানান ২৪ ঘণ্টায় প্রায় কিয়েভ থেকে ৫৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন গাড়িতে বসেই। কিন্তু ভাড়াকৃত সে বাসটি লাভিভ শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরেই যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। মাহবুব পায়ে হেঁটে লাভিভ শহরের দিকে এগোতে থাকেন। শেষে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে মেট্রোরেলের ওঠেন তিনি। বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটার দিকে মাহবুবের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তখন তিনি জানান, পোল্যান্ড সীমান্ত পৌঁছাতে হলে লাভিভ শহরে আগে পৌঁছাতে হবে। এরপর লাভিভ শহর থেকে ছোট কোনো যানবাহন ভাড়া নিয়ে ছুটতে হবে পোল্যান্ডের সীমান্তের দিকে। লাভিভ শহর থেকে পোল্যান্ডের সীমান্ত আরো প্রায় ৭৩ কিলোমিটার।
মাহবুব জানান পথে খাবারের কোন হোটেল তারা পাননি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন গাড়ির মধ্যে। রাস্তায় প্রচন্ড যানজটের কারণে তাদের গাড়ি ও ধীর গতিতে চলছিল। ফলে প্রায় ৫৭৫ পথ পাড়ি দিতেই ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে যায় তাদের। স্বাভাবিক সময়ে ইউক্রেনের এই পথ পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ৫ ঘন্টা।


এদিকে গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এই প্রতিবেদক এর সঙ্গে কথা হয় রাজশাহীর নুরুল আমিন শাকিল এর সঙ্গে। শাকিল জানান তারা প্রায় ৩০ ঘন্টায় লাবিব শহরে পৌঁছান সেখানকার সময় বিকেল তিনটার দিকে।  কিন্তু এরই মধ্যে লাভিভ শহরে শুরু হয় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বোমা বিস্ফোরণ। আর জনগণকে সতর্ক করতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তখন রাস্তায় নেমে জরুরি সাইরেন বাজাতে শুরু করেন। সেনাবাহিনী সাইরেনের শব্দে লাভিভ শহরের সাধারণ মানুষও রাস্তায় ছুটোছুটি শুরু করে আতঙ্কে। পাশাপাশি বাংলাদেশী প্রবাসীরা যারা লাবিব শহরে পৌঁছান তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক নেমে আসে। ওই শহরের  ব্যাংকের বুথগুলোতে টাকা তোলার জন্য উপচে পড়া ভিড় বাড়তে থাকে।

শাকিল এই প্রতিবেদককে বলেন, লাভিভ শহর থেকে আরো ৭৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পোল্যান্ডের সীমান্ত। কিন্তু সেখানে যেতে আমরা তেমন কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। ফলে যানবাহনের অপেক্ষা করছিলাম। এরইমধ্যে রাশিয়ান বাহিনী এই শহরেও বোমা বিস্ফোরণ শুরু করলে চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি আমরা। এখন জীবন নিয়ে পরান সীমান্তে পৌঁছাতে পারবো কিনা সেই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে আমাদের মাঝে।

শাকিল বলেন, কিয়েভ শহর থেকে লাভিভ শহরের যে মূল রাস্তাটি, সেই রাস্তা ধরে আমরা আসতে পারিনি। যানজট ও রাশিয়ান বাহিনীর চেকপোস্টের কারণে বিকল্প পথে আসতে হয়েছে আমাদের। রাস্তায় তেমন কোনো খাবারও পায়নি। শুকনো যে খাবার অল্প পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছে কোনো দোকানে সেখানেও দাম দ্বিগুন আদায় করা হচ্ছে। সেগুলো গাড়ির মধ্যেই বসে কোনমতে খাচ্ছি। যখন গাড়ি কোথাও যানজটে আটকা পড়ছে, তখন টয়লেট সেরে নিচ্ছি।’
শাকিল বলেন, বুথে টাকা তুলতে না পেরে টাকা সংকটে পড়েছি। আববন গাড়ি ভাড়াও পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে হেঁটে পথ ধরেছি। আমাদের দলে পাকিস্তা,  ইন্ডিয়া এবং আফ্রিকান মিলে অন্তত ২৫ জন রয়েছে। তারা সবাই হেঁটে পথ ধরেছে পোল্যান্ডের দিকে। গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত পোল্যান্ড সীমান্তে বাংলাদেশী প্রবাসী সাতজন পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছেন শাকিল।

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাভলীর এই প্রতিবেদককে জানান, পোল্যান্ড পৌঁছাতে আরও ৭৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে তাদের। কিন্তু যানবাহনের অভাবে তারা বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে এই পথ পাড়ি দিতে ছুটতে শুরু করেছেন।

স/আর