২৫ হাজার টাকার লোভেও বেসামাল অনেক কর্মকর্তা

সরকারি গাড়ির জ্বালানি তেল চুরিতে ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বহু পুরনো। কিন্তু শীর্ষপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাও গাড়ির জ্বালানি নয়ছয় করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি পাওয়া শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে তেলের দাম নিচ্ছেন সরকারি কোষাগার থেকে। বারবার চিঠি দিয়েও বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একাধিকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করলেও বস্তুত কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না জনপ্রশাসন। জানা গেছে, কিছু মন্ত্রণালয়ের ‘ক্ষমতাধর’ সচিবও নীতিমালা লঙ্ঘন করে দ্বিগুণ জ্বালানি খরচ নিচ্ছেন। এ কারণে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ইতস্তত বোধ করছে জনপ্রশাসন।

সম্প্রতি বিষয়টি উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেও সতর্ক করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত চার দফা চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চিঠি দিয়ে লাভ কী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যাঁদের কাছে চিঠি পাঠায়, অর্থাৎ অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরাই দুর্নীতির আশ্রয়ে জ্বালানি তেল নিচ্ছেন। এসব শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা তাঁদের অধীনদের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা নেবেন!

সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর এ বিষয়ে সতর্ক করে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন। চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে মন্ত্রিপরিষদসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের কাছে।

উল্লেখ্য, ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা’-এর আওতায় উপসচিবরা সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি পান। সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে একজন কর্মকর্তা ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত কিস্তি দিলেই গাড়িটি ব্যক্তিগত হয়ে যায়। গাড়ির ড্রাইভার, ব্যবস্থাপনা ও জ্বালানি খরচের জন্য সরকার প্রতি মাসে ৫০ হাজার করে টাকা দেয়। যেসব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে সরকারি গাড়ি পান নীতিমালা অনুযায়ী সেসব কর্মকর্তা প্রতি মাসে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য সরকারি খরচের অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ হাজার টাকা করে নেবেন। সব সচিব সরকারি দপ্তর থেকে গাড়ি পান। কিন্তু অনেক সচিব বিষয়টি জানার পরও সরকারি কোষাগার থেকে গাড়ির খরচ বাবদ ২৫ হাজার টাকার বদলে ৫০ হাজার টাকাই তুলে নিচ্ছেন। আর অতিরিক্ত সচিব থেকে উপসচিবদের মধ্যে বেশির ভাগই এই অনিয়মে জড়িত বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিবদেরও অনেকের দায়িত্বভেদে দপ্তর-সংস্থার গাড়ি পান। এঁদের মধ্যে যাঁরা সরকারি গাড়ি পান না, তাঁরা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পুলের গাড়িতে চড়ে ব্যক্তিগত গাড়ি বসিয়ে রেখে ৫০ হাজার টাকা তুলে নেন। এসব বিষয়ে সচিবালয়ের নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায়ই তির্যক মন্তব্য করেন। তাঁরা বলেন, সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের কর্মকর্তারা যদি ২৫ হাজার টাকার লোভ না ছাড়তে পারেন, তাহলে লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেটের দায়িত্বে থাকা এসব কর্মকর্তা উন্নয়ন প্রকল্পে কী করেন, তা সহজেই বোঝা যায়।

কিছু লোভী অসৎ কর্মকর্তার জন্য নাক কাটা যাচ্ছে পুরো প্রশাসনের। যাঁরা সরকারি নিয়ম মেনে জ্বালানি তেলের খরচ নেন, সেসব কর্মকর্তা বলছেন, যাঁরা তেল চুরির অপরাধে যুক্ত, তাঁদের শাস্তির আওতায় না এনে বছর বছর চিঠি দিলে কোনো লাভ হবে না। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা হয়ে যাঁরা ২৫ হাজার টাকার লোভ সামলাতে পারেন না, সেসব কর্মকর্তা তো মহাদুর্নীতিবাজ। এঁদের ধরে ধরে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো শুরু করলে কেউ তেলের টাকায় দুর্নীতি করার সাহস পাবে না।

এসব কর্মকর্তার অভিযোগের সত্যতাও মিলছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিকবার দেওয়া চিঠির সূত্রে। তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব (গাড়িসেবা) শরীফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সরকারি টাকায় গাড়ি কেনা এবং তেল ব্যবহার নিয়ম মেনে করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই নিয়মে কেউ কর্ণপাত করেনি। উল্টো গাড়িতে জ্বালানি খরচের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ অক্টোবর আবারও জ্বালানি তেল ব্যবহারের নিয়ম মানার কথা উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত বছর দেওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে গাড়ির তেল ব্যবহারের বিষয়ে অনিয়ম করলে ‘অসদাচরণ ও দুর্নীতি আওতাভুক্ত অপরাধ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কাজে যুক্ত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না দিয়ে আবারও চিঠি দেওয়ার মানে কী এই দাঁড়ায় না যে তেল চুরি করলে যাই হোক, চিঠির বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না!  গত বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা’ অনুযায়ী ‘সুদমুক্ত ঋণ’ গ্রহণকারী কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রেষণ, মাঠ প্রশাসন, প্রকল্পে কর্মরত থাকা অবস্থায় সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ৫০ হাজার টাকা তুলছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা নেওয়া হয়নি।

জ্বালানির অনিয়মের কারণে সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও বিরক্ত। এ কারণে  চলতি বছর গাড়ি নীতিমালা সংশোধন করে সরকারি টাকায় গাড়ি পাওয়া আরো কঠিন করে দিয়েছে সরকার। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, কেউ উপসচিব পদোন্নতি পেলেই গাড়ি কেনার ঋণ পাবেন না। উপসচিব হিসেবে চাকরির তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেই সুযোগ মিলবে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ