হারিয়ে যাচ্ছে ঢেঁকি

সিল্কিসিটিনিউজ ডেস্ক:

একসময় গ্রামগঞ্জে ধান ভানা, চাল তৈরি, গুঁড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙানোসহ বিভিন্ন কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো ঢেঁকি। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কৃষক ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষানিদের ঘরে ধান থেকে নতুন চাল ও চালের গুঁড়া করার ধুম পড়ে যেত। সে চাল দিয়ে পিঠা-পুলি, ফিরনি-পায়েস তৈরি করা হতো। ঢেঁকি বড় কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি। লম্বায় অন্তত ছয় ফুটের মতো। এর অগ্রভাগে দেড় ফুট লম্বা মনাই। মনাইয়ের মাথায় পরানো লোহার রিং। চুরন বারবার যেখানে আঘাত করে, নিচের সেই অংশটুকুর নাম গর। সেটিও কাঠের তৈরি। ঢেঁকিতে ধান বা চাল মাড়াই করতে কমপক্ষে তিনজন মানুষের প্রয়োজন হয়। পেছনের লেজবিশিষ্ট চ্যাপ্টা অংশে এক বা দুজন পা দিয়ে তালে তালে চাপ দিলে মনাই সজোরে গরের ভেতর ধান বা চালের ওপর আঘাত করে। তবে মনাই ওঠানামার ছান্দিক তালে তালে আরও একজন নারী ধান-চাল মাড়াই করতে সাহায্য করে। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া আর আলি দেওয়ার মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে ঘটতে পারে ছন্দপতন।

ঢেঁকি এখন দাদি-নানিদের স্মৃতির গল্পে পাওয়া যায়। ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে অনেকের হাতে আঘাত লেগেছে, আঙুল ভেঙেছে। পাড়াগাঁয়ে প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা যায় ঢেঁকিতে ধান ভেনে আটা তৈরির রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। তখন বধূরা ঢেঁকিতে কাজ করত রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। একসময় মানুষ ঢেঁকিতে ধান ও চাল ভেনে চিড়া-আটা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত হতো বাংলার জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ শোনা যায় না। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখন দু-চার গ্রাম খুঁজে পাওয়া ভার। প্রয়োজনের তাগিদে সময়ের সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে সমাজ উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। প্রাচীন যুগের মানুষ প্রকৃতিকে দেখে, শিক্ষা নিয়ে বছরের পর বছর সময় নিয়ে একেকটি আবিষ্কার করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে সভ্যতার পালেও আধুনিকতার ঢেউ লেগেছে। আগে বিভিন্ন কাজ করতে বেশি সময় ও শ্রম লাগত। সে তুলনায় মানুষ এখন সব দিক দিয়েই সাশ্রয়ী। তবে যে জিনিসের ভালো আছে, তার একটি মন্দ দিকও আছে। জীবনের সব ক্ষেত্রে মানুষ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অলস হয়ে পড়ছে। আগে মানুষ সব কাজ শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে করত। কিন্তু এখন প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে মানুষ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। ঢেঁকির পরিবর্তে বিদ্যুৎচালিত মটরের মাধ্যমে ধান, চাল, মরিচ, হলুদ, সরিষা ইত্যাদি ভানা হচ্ছে। এতে সময় ও পরিশ্রম কম হলেও মেশিনে ভানা আটায় তৈরি দ্রব্য ঢেঁকিতে তৈরি আটার মতো হয় না। ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অপরদিকে মেশিনে ভাঙানো চালের ভাতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি।

শুধু তাই নয়, ঢেঁকি বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের পরিচায়ক। কালের বিবর্তনে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাড়াগাঁয়ের কিছু লোক মিলে টাকা তুলে কাঠ দিয়ে ঢেঁকি বানিয়ে এখনো ঐতিহ্যের চিহ্নটুকু ধরে রেখেছেন। কিন্তু আমাদের অতি আধুনিক হওয়ার লোভের রোষানলে সেটুকুও বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। অতি উন্নতির জোয়ারে ভাসতে গিয়ে আমরা প্রাচীন ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিতে বসেছি। এমনটি কাম্য নয়।

সূত্র: যুগান্তর