হঠাৎ হঠাৎ রক্তপাত, দিশাহারা চিকিৎসকেরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দশেকের মেয়ে স্কুলের বন্ধুদের এখন বোঝায়— ‘‘হঠাৎ করে যদি দেখিস আমার মুখ দিয়ে, কপাল দিয়ে বা পা দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, ভয় পাস না কিন্তু। আমার ও রকম একটু হয়!’’

প্রথমে অবশ্য সে-ও খুব ভয় পেয়েছিল। কথা নেই, বার্তা নেই, এক দিন হঠাৎ নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল। সেটা ২০১৬ সালের মে মাস। এত রক্ত যে, নাকের নীচে বাটি ধরে রাখতে হয়েছিল। দশ বছরের ছোট্ট সায়ন্তী ভাদুড়ীর মা সোমার কথায়, ‘‘এক বার করে বাটি ধরছি, আর সেই বাটি ভরে যাচ্ছে। পাড়ার ডাক্তারের কাছে যখন নিয়ে গেলাম, তিনিও দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। যক্ষ্মার পরীক্ষা করাতে বললেন। হাতে সিরিঞ্জ ফোটাতেই হাত দিয়ে টানা রক্ত বেরোতে শুরু করল। এই ভাবে টানা দশ দিন চলেছিল। ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম।’’ তার পর থেকেই কয়েক মাস বা কয়েক দিন বাদ দিয়ে দিয়ে এই অদ্ভুত রক্তপাত চলছে। কখনও নাক দিয়ে, কখনও কান দিয়ে, হাত বা পা দিয়ে, কপাল বা ভুরু দিয়ে। কোনও কাটাছেঁড়া নেই, ধাক্কা লাগা নেই! আচমকা শুরু হয়, আচমকা বন্ধ হয়।

কলকাতার সব নামী হাসপাতাল, এমনকী ভেলোরেও মেয়েকে নিয়ে ঘুরে এসেছেন বাবা-মা। গাদা গাদা পরীক্ষার পরেও রক্তপাতের কারণ ঠিক ভাবে পাওয়া যায়নি। তবে চিকিৎসকদের ধারণা, এটি অতি বিরল রোগ ‘হেমাটাইড্রোসিস’ বা ‘হেমাটোহাইড্রোসিস’। সেই খ্রিস্টের জন্মের সময় থেকে শুরু করে প্রাচীন ইতিহাসের বিভিন্ন গল্পগাথায় এই রোগের উল্লেখ রয়েছে। যিনি এখন সায়ন্তীর চিকিৎসা করছেন, সেই ইনটেনসিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ নির্মাল্য রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘ভেলোরে ওকে পরীক্ষা করে কেউ কিছু বুঝতে পারেননি। তার পরে ওকে মনোবিদ দেখানোর পরামর্শ দেন ওঁরা। সেটা শুনে অভিভাবকেরা আবার কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। সব কিছু দেখে আমাদের মনে হয়েছে, ও বিরল ‘হেমাটাইড্রোসিস’-এ ভুগছে।’’ চিকিৎসকদের ব্যাখ্যায়, কিছু মানুষের রক্তজালিকা খুব পাতলা হয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপের মুহূর্তে ঘর্মগ্রন্থির সঙ্গে যুক্ত রক্তজালিকা ফেটে যায় ও ঘামের সঙ্গে রক্ত মিশে বেরিয়ে আসে। ফাঁসির আসামিদের বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার পরে এই রকম ঘামরক্ত বেরোনোর একাধিক ঘটনা রয়েছে।

সায়ন্তীও এখন বিষয়টিতে অনেকটা অভ্যস্ত। ‘‘আমার তো ব্যথা করে না। শুধু রক্ত বেরিয়ে আসে। স্কুলে কখনও শুরু হলে আমি রুমাল দিয়ে মুছতে থাকি। এক বার মোজাটা পুরো ভিজে গেল। আমি মোজা খুলে রাখলাম। না হলে বন্ধুরা ভয় পেয়ে যায়। আমি ওদের বোঝাই,’’— বেহালার শীলপাড়ার বাড়িতে বসে হাসতে হাসতেই বলে সায়ন্তী। বাবা তপন ভাদুড়ী জানালেন, স্কুলের দিদিমণিরাও আতঙ্কিত হয়ে ওকে স্কুলে আসতে বারণ করে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের চিঠি নিয়ে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনার পরে তাঁরা বুঝেছেন।

কাকতালীয় ভাবে এই মুহূর্তে দক্ষিণ কলকাতার এক শিশু হাসপাতালেও ১৩-১৪ বছরের একটি মেয়ে ভর্তি রয়েছে, যার হুবহু একই উপসর্গ। তার চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘দেড় বছর আগে থেকে ওর কপাল-মুখ-নাক দিয়ে মাঝেমাঝেই গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। এই মেয়েটিও ভেলোর গিয়েছিল। আমরা এখনও রোগের কারণ খুঁজে পাইনি।’’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চলতি বছর হায়দরাবাদে তিন বছরের অহনা আফজলেরও এই উপসর্গ পাওয়া গিয়েছে। ২০১৩ সালে এসএসকেএমের পেডিয়াট্রিক মেডিসিনে এই রকম উপসর্গ নিয়ে ১৩ বছরের এক বালিকা ভর্তি হয়েছিল। এমন দু’টি কেস পেয়েছিলেন ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রি’র (আইওপি) চিকিৎসকেরাও। দু’টিই ছিল বছর চোদ্দোর বালিকা। তাদের মধ্যে হাওড়ার বাসিন্দা এক জনের ঘামের সঙ্গে রক্ত বেরোত। দ্বিতীয় জন ছিল ঢাকার বাসিন্দা। তার রক্ত বার হত চোখ থেকে।

আইওপি-র মনোবিদ প্রশান্ত রায়ের কথায়, ‘‘প্রথম বাচ্চাটিকে কয়েক বার পরিবারেই যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। আর দ্বিতীয় জনের অস্বাভাবিক পরীক্ষা-ভীতি ছিল। কাউন্সেলিং করে দু’জনকে ঠিক করা গিয়েছিল। ফলে মানসিক চাপের যোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’