সড়কে নৈরাজ্য রুখছে শিক্ষার্থীরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

উত্তেজনা কমাতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ শিক্ষকদের বাধার মধ্যেও দলে দলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। গতকাল সকাল থেকেই বিচ্ছিন্ন অবরোধে অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। সকাল ১১টার দিকে বনানী ফ্লাইওভার, বিমানবন্দর, উত্তরা, মিরপুর ১৪ নম্বর, রামপুরা ব্রিজ, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, মেরাদিয়া, বনশ্রী, বাংলামোটর ও আজিমপুর এলাকায় শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ করে থাকতে দেখা গেছে।

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনায় গতকাল বুধবারও রাজধানীতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ছিল প্রতিবাদে সোচ্চার। গতকাল তাদের অংশগ্রহণ ছিল আগের তিন দিনের চেয়ে অনেক বেশি। সকালে উত্তরা, ফার্মগেট, রামপুরা, সায়েন্স ল্যাব ও যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় রাস্তায় শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও ঘাতক চালকদের বিচারের দাবিতে স্লোগান দেয়। তারা চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষাও শুরু করে। কাগজপত্র ঠিক ছিল না এমন চালকদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলও তারা আটকে দেয়। পুলিশের গাড়ি, এমনকি একজন মন্ত্রীর গাড়িকেও এক অর্থে ছাড় নিতে হয়েছে ছাত্রদের কাছ থেকে। এরই মধ্যে শনির আখড়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর দিয়ে এক চালক পিকআপ চালিয়ে দিলে গুরুতর আহত হয় এক ছাত্র।

গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বনানী, মিরপুর, বাড্ডা-প্রগতি সরণি, র‌্যাডিসনের সামনের দুর্ঘটনাস্থল, বাংলামোটর, শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়। শনির আখড়ায় শিক্ষার্থীদের চাপা দিয়ে একটি পিকআপ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এক ছাত্র নিহত হয়েছে—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে আরো উত্তেজনা বাড়ে। তবে গতকাল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছিল অনেকটাই শান্ত। বিমানবন্দর সড়ক, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর ছাড়া কোথাও গাড়ি ভাঙচুর করেনি তারা। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া পুলিশের সদস্যদের শান্ত থেকে দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দেন। গতকাল পুলিশও শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করতে বাধা তৈরির চেষ্টা করেনি। বিকেল ৪টার পর বৃষ্টি শুরু হলে শিক্ষার্থীরা রাজপথ থেকে সরে যায়। এর আগে তারা অভিযুক্ত বাসচালকের ফাঁসির দণ্ড, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো বন্ধ, নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি আদায় না হলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় রাস্তায় মিলিত হওয়ার আহ্বানও জানায় তারা।

সড়কে শিক্ষার্থীদের জেরা, চলাচলে বাধা ও বাস না পেয়ে হয়রানির মুখে পড়া মানুষও আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, সাময়িক কষ্টের কারণ হলেও শিশু-কিশোররা ন্যায্য দাবি করছে এবং অনিয়মের গোড়ায় হাত দিয়েছে। তাই দাবির বাস্তবায়ন চায় দুর্ভোগে আক্রান্তরাও।

যে দুই শিক্ষার্থী রবিবার নিহত হয় বাসচাপায় তাদের প্রতিষ্ঠান শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ আজ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানকার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বাধাও দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে থামানো যায়নি ছাত্র-আন্দোলন।

গতকাল সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পয়েন্টে নেমে সড়ক অবরোধ করে। গতকালও ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সড়ক অবরোধের আহ্বান জানানো হয়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এতে সংহতি জানাতে দেখা যায়।

গতকাল সকাল ১০টার পর থেকে শহরের উত্তরা থেকে দক্ষিণ প্রান্তের শনির আখড়া পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলে। একপর্যায়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। সবার স্লোগান ছিল ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’। শিক্ষার্থীদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখা যায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘বিবেক তুমি কবে ফিরবে’। বিক্ষোভ থেকে সন্তানকে বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় থাকা এক মা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার কেন এটার এখনো সমাধান দিচ্ছে না? সরকার দাবিগুলো মেনে নিক, যাতে আমাদের সন্তানরা দ্রুত বাড়িতে ফিরে যেতে পারে।’

ফার্মগেট : সকাল ১০টার দিকে ফার্মগেটে তেজগাঁও কলেজ ও বিএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। তারা সড়কে ভাঙচুর না করে গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে থাকে। মিছিল নিয়ে এই শিক্ষার্থীরা কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ হয়ে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় অবস্থান নেয়। এ সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ ও শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এদিকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়কে দনিয়া কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। তারা রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করতে থাকে। যানবাহন চলাচল করলেই শিক্ষার্থীরা ধাওয়া করে। এ সময় ফয়সাল মাহমুদ নামের এক শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় একটি পিকআপ ভ্যান। এতে ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সড়ক বন্ধ করে দেয় শিক্ষার্থীরা।

লাইসেন্স তল্লাশি : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ফার্মগেট থেকে শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যাওয়ার সময় বিআরটিসি বাসসহ সকল গণপরিবহন ও চালকদের লাইসেন্স আছে কি না তা তল্লাশি করে। এ সময় মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের গাড়িও আটকে দেয় শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টার দিকে বাংলামোটর এলাকায় নৌ মন্ত্রণালয়ের একটি গাড়ি আটকে গাড়ির লাইসেন্স আছে কি না তা জিজ্ঞাসা করা হয়। লাইসেন্স আছে জানালে তারা গাড়িটি ছেড়ে দেয়।

ধানমণ্ডিতে শিক্ষার্থীদের লাইসেন্স দেখাতে না পারায় পুলিশের একটি গাড়িকে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয়। একই ধরনের সমস্যায় পড়ে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বেশ কয়েকটি গাড়ি। বাংলামোটরে উল্টো পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের গাড়ি শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে। মন্ত্রীর সামনেই শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয়, ‘আইন সবার জন্য সমান।’

এদিকে শিক্ষার্থীদের পাল্টা হিসেবে নারায়ণগঞ্জে পরিবহন শ্রমিকরাও সকাল থেকে ছয় ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আটকে রেখে বিক্ষোভ করে। সেখানে রাস্তায় স্কুলছাত্রদের মারধরও করে তারা।

অবরুদ্ধ উত্তরা : সকাল সাড়ে ১০ থেকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং থেকে শুরু করে কুর্মিটোলা র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে পর্যন্ত বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, মাইলস্টোন কলেজ, স্কলাসটিকা, টঙ্গী কলেজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক আটকে বিক্ষোভ করে। পুলিশ এলে শিক্ষার্থীরা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা কয়েকটি ভাগে দলবদ্ধ হয়ে অবরোধে আটকে পড়া বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের লাইসেন্স আছে কি না তা পরীক্ষা করে।