বাসে উঠতে নামতে পিষ্ট নারী-শিশু

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানীতে গণপরিবহনে চলাচলে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা। পর্যাপ্ত বাসের অভাব, পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে ভিড় ঠেলে বাসে ওঠার চেষ্টা, বাসে ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে চালকের সতর্কতার অভাবে দুর্ঘটনার শঙ্কা, বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি নানা রকম সংকট সঙ্গী করেই প্রতিদিন তাদের পথ চলতে হয়। অনেকে বাসের পুরুষ যাত্রী বা বাসচালকের সহকারীদের মাধ্যমে অনৈতিক আচরণেরও শিকার হয়ে থাকে। প্রতিদিন একই সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে গণপরিবহনে চলা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের। এ সংকট উত্তরণে রাস্তায় গণপরিবহন বৃদ্ধির পাশাপাশি নারীদের জন্য পৃথক বাস চালুর সুপারিশ করেছেন অনেকে।

সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গণপরিবহনে চলাচলকারী নারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের নানা রকম ভোগান্তির কথা জানা যায়। একদিন সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, অনেক যাত্রীর সঙ্গে মতিঝিলগামী বাসের অপেক্ষায় আছেন শামিয়া জামান। তিনি বলেন, ‘মতিঝিলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। পর পর তিন দিন অফিস নির্ধারিত সময় সকাল ৯টার পর পৌঁছালে এক দিনের বেতন কেটে নেওয়া হয়। তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চা-সংসার সামলে ৮টার আগেই বাসস্টপেজে চলে আসি। কিন্তু বাসের তুলনায় যাত্রী বেশি থাকায় ভিড় ঠেলে সংগ্রাম করে কোনো রকমে বাসে উঠতে পারলেও বেশির ভাগ সময় দাঁড়িয়েই গন্তব্যে যেতে হয়।’

অফিস ছুটির পরের ভোগান্তি আরো বেশি জানিয়ে শামিয়া জামান বলেন, ‘বিকেলে মতিঝিলের অধিকাংশ অফিস একসঙ্গে ছুটি হয়। তখন এত ভিড় থাকে যে বাসের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। অধিকাংশ সময় দুই-তিন ঘণ্টায়ও বাসে ওঠার সুযোগ মেলে না।’

মগবাজার এলাকা থেকে ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোডের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেন পাপিয়া জেরিন। তিনি জানান, ব্যবহারিক ক্লাস শেষ হতে অনেক সময় রাত হয়ে যায়। তখন কম যাত্রী আছে এমন বাসে উঠলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় কি না সে আতঙ্কও কাজ করে। রাতে সিএনজি, ট্যাক্সি ক্যাব বা উবারে উঠতেও ভরসা পান না তিনি। এ ছাড়া সার্ভিসের মধ্যে বিশেষ করে সিএনজি মিটারের তুলনায় ভাড়া অনেক বেশি নেয়।

গৃহিণী নীরা ইসলাম খিলক্ষেত থেকে ফার্মগেটে চিকিৎসকের কাছে আসতে বাসে উঠে সিট পেলেন না। এদিকে ভিড়ের মধ্যে কে যেন ওড়না টেনে ধরল। বেইলি রোডে ভিকারুননিসার সামনে মেয়ের ছুটির জন্য অপেক্ষারত দিলারা রহমান বলেন, মিরপুর পল্লবী থেকে বাসে, টেম্পোতে, কখনো বা লেগুনায় বেইলি রোডে ভিকারুননিসা স্কুলে সময়মতো পৌঁছানো এবং স্কুল শেষে বাসায় ফেরা বেশ কঠিন কাজ। গণপরিবহনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে মেয়েকে নিয়েও দুশ্চিন্তা তাঁর। মেয়ে রিতিকা ধানমণ্ডির ছায়ানটে গান শেখার সুযোগ পেলেও গণপরিবহনে চলাচলে ঝক্কির কারণে গান শেখা হচ্ছে না। দিলারা রহমান বলেন, ‘নারী ও শিশুদের চলাচলের জন্য আলাদা বাস থাকলে স্বস্তিতে মেয়েকে নিয়ে চলাফেরা করতে পারতাম।’

অনেক মা-বাবা শিশুদের স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন রুটে পৃথক বাস সার্ভিস চালুর পরামর্শ দিয়ে বলেন, এতে যানজট কমবে। চলাফেরার ঝক্কি এড়িয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠে মনোযোগী হতে পারবে। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সু্কলে যাওয়া-আসার জন্য উন্নত দেশগুলোর মতো আলাদা বাস সার্ভিসের প্রতি সমর্থন জানান মিরপুর স্কলাসটিকা স্কুলের একাধিক অভিভাবক। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাঁরা সরকারের কোষাগারে আলাদা অর্থ জমা দিতে রাজি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, সহজ যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে নারীরা অনেক কিছুই করতে পারছে না। বিশেষ করে তারা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না। পৃথক বাস সার্ভিসে স্কুল-কলেজের ছাত্রী ও স্বল্প আয়ের নারীদের বিনা মূল্যে চলাচলের ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, জনবহুল এ শহরে চাহিদার তুলনায় গণপরিবহন অনেক কম। যে অল্প কিছু ট্যাক্সি ক্যাব বা সিএনজি আছে, তার ভাড়াও এত বেশি, যা কর্মজীবী নারীদের সামর্থ্যের প্রায় বাইরে। বাধ্য হয়েই মেয়েরা ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠছে। গণপরিবহনগুলোতে নারীদের বসার সুব্যবস্থা থাকে না বললেই চলে। এভাবে প্রতিদিন যুদ্ধ করে একটি নারীর পক্ষে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কাজ করা কঠিন।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে সরকারি উদ্যোগে নারীদের চলাচলের জন্য রাজধানীতে ৭০টি বাস নামানো হয়। অব্যবস্থাপনাসহ নানা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এসব বাসের অধিকাংশই এখন অচল।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজধানীতে ভোটার সংখ্যায় নারী-পুরুষ প্রায় সমান। কিন্তু এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো পরিবহন নেই। এ ক্ষেত্রে নারীরা বঞ্চিত। চাহিদার তুলনায় কম খরচে চলাচল উপযোগী তাদের যানবাহন নেই বললেই চলে। নারীদের চলাচলের সমস্যা নিরসনে সরকারের আরো মনোযোগী হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, নারী ও শিশুদের চলাচলে দুর্ভোগের বিষয়টি রাজধানীর একটি অন্যতম সমস্যা। এটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।