সুন্দরবনে ৪ বছরে ৪ বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার, মৃত্যুর ধরন একই

সুন্দরবনে আরো একটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা টহল ফাঁড়ির আওতাধীন আলোর কোলসংলগ্ন রুপার গাঙ (খাল) এলাকা থেকে এই পুরুষ বাঘটির মৃতদেহ উদ্ধার করে বনরক্ষীরা। গত চার বছরে শরণখোলা রেঞ্জের বিভিন্ন নদী ও খালের চর থেকে এ নিয়ে চারটি বাঘের মরদেহ উদ্ধার হলো।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয়টি হলো পর পর চারটি বাঘের মৃত্যুর ধরন একই।

একারণে প্রাণি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সবগুলো বাঘ কেনো নদীর কিনারে এসে মারা যচ্ছে। বাঘগুলো কি চোরা শিকারীদের বিষটোপ খেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে? নাকি বার্ধক্য বা অন্য কোনো কারণে মারা যাচ্ছে। এসব বিষয় ক্ষতিয়ে দেখে বিপন্নতার হাত থেকে বাঘ রক্ষায় ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে বনবিভাগকে। তবে, বনবিভাগ দাবি করছে, এযাবতকালে যতোগুলো বাঘের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, তার সবগুলোরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এর একটি তদন্ত রিপোর্টও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি বনবিভাগ।

সুন্দরবন সুরক্ষায় নিয়োজিতদের তথ্য মতে, বনসংলগ্ন এলাকায় একাধিক বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণি শিকারে শক্তিশালী চক্র রয়েছে। বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে বাঘ-হরিণ শিকার করে এরা। সবসময়ই তৎপর তারা। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাঘের চামড়া উদ্ধার হওয়ায় বাঘ শিকারীদের সক্রিয়তার প্রমাণ মেলে। এদের ব্যাপারে বনবিভাগ ও আইসশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে।

এদিকে, রুপার গাঙ থেকে উদ্ধার হওয়া বাঘটির ময়না তদন্ত শনিবার (২৯ জানুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে শরণখোলা রেঞ্জ অফিস চত্বরে সম্পন্ন করা হয়। ময়না তদন্ত করেন শরণখোলা উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. তফাজ্জল হোসেন।
এ সময় শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শামসুল আরেফিন, খুলনার ওয়াইল্ড লাইফ বিভাগের রেঞ্জার মো. লুৎফর পারভেজসহ বনবিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ময়নাতদন্ত শেষে বাঘের মৃতদেহটি আরো ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে ওয়াইল্ড লাইফ বিশেষজ্ঞরা মৃতদেহটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন বলে বনবিভাগ জানিয়েছে।

ময়না তদন্ত সম্পন্নকারী কর্মকর্তা ডা. তফাজ্জল হোসেন জানান, পুরুষ বাঘটির দৈর্ঘ্য ৯ ফুট, উচ্চতা ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি, বেড় ৪ ফুট ২ ইঞ্চি। বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর হবে। শরীর, দাঁত, নখ, লিভার, পাকস্থলী সবই স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। ফরেনসিক টেস্টের (রাসয়নিক) জন্য বাঘের লিভার, পাকস্থলী, কিডনি, দাঁত ও জিহ্বার নমুনা নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণ করা হচ্ছে বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা সম্ভব না।

সুন্দরবন সহব্যবস্থপনা কমিটির সহসভাপতি (সিএমসি) এম ওয়াদুদ আকন বলেন, সবগুলো মৃত্যুর ধরন একই রকম হলে সেখানে সন্দেহ দেখা দেয়। এখানে শিকারীদের হাত থাকতে পারে। পর পর কয়েকটি বাঘের মৃতদেহ নদীর চরে পাওয়া এটা উদ্বেগের কারণ।

সিএমসি নেতা ওয়াদুদ আকন আরো বলেন, শরণখোলার উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন সোনাতলা এবং পাথরঘাটার চরদুয়ানী ও জ্ঞানপাড়া এলাকায় শক্তিশালী একাধিক শিকারী চক্র রয়েছে। এরা একজনের সাথে আরেক জন নিবিড় সম্পর্কে জড়িত। এই সিন্ডিকেট দমন করা না গেলে বাঘসহ বন্যপ্রাণি নিধন বন্ধ করা যাবে না। এদেরকে বনবিভাগের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. এম এ আজিজ বলেন, সব প্রাণিরই স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে। তবে, মৃত্যুর কারণ এবং ধরণ একই হলে বিষয়টি ভিন্ন। সেক্ষেত্রে ফরেনসিক রিপোর্টের মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব। সেই রিপোর্ট যাতে সঠিক হয় সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক হতে হবে। সঠিক রিপোর্টই বাঘসহ সকল প্রাণি সংরক্ষণে সহায়ক হবে।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. শামসুল আরেফিন বলেন, রেঞ্জ অফিস চত্বরে বাঘের ময়না শেষে অধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মৃতদেহটি চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। বাঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে ডিভিশন অফিসে। দু-একদিনের মধ্যে সেগুলো ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে। তবেই মৃত্যু সঠিক কারণ জানা যাবে।

সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (ওয়াইল্ড লাইফ) ডিএফও নির্মল কুমার পাল বলেন, একটি বাঘ সাধারণত ১৫ থেকে ১৮ বছর বাঁচে। সেক্ষেত্রে সুন্দরবনে যে পরিমাণ বাঘ রয়েছে, তাতে বয়সের কারণে প্রতিবছর দু-চারটি বাঘ এমনিতেই মারা যাওয়ার কথা। মৃত বাঘটির বয়সও ১৫-১৬ বছর। তাতে মনে হচ্ছে এটিরও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অন্য কোনো কারণে মারা গেলে সেটা ভিসেরা রিপোর্ট পেলে জানা যাবে।

ওয়াইল্ড লাইফের ডিএফও নির্মল কুমার পাল আরো বলেন, ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপে বাংলাদেশ অংশে ১১৪টি বাঘের হিসাব রয়েছে। নতুন করে জরিপ হলে বাঘ বেড়েছে না কমেছে সেটা বোঝা যাবে। ভারতে ইতিমধ্যে বাঘ গণনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বাঘ গণনার জন্য দুই বছর আগে একটি প্রস্তাব পঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সেটা পাস হয়নি। বাঘ ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

পূর্বের তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে জানার জন্য পূর্ব বনবিভাগের পিএফও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেনি।

এর আগে ২০২১ সালের ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের ধনচেবাড়িয়া চর থেকে ১টি, ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কোকিলমুনির কবরখালী এলাকা থেকে ১টি এবং ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট কটকা অভয়ারণ্য এলাকার ছাপড়াখালী থেকে ১টিসহ মোট তিনটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ২০২১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাগেরহাটের ফকিরহাট থেকে এবং একই বছরের ১৯ জানুয়ারি শরণখোলা উপজেলার রাজৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে পৃথক ২টি বাঘের চামড়া উদ্ধার ও দুই পাচারকারীকে আটক করা হয়।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ