সংকট-দুর্যোগে কুরবানি

সংকট-দুর্যোগের মধ্যদিয়ে ঈদুল আযহা আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। বিগত এক শতকে দেশে এমন পরিস্থিতিতে ঈদ উদযাপন হবার কোন নজির নেই। একদিকে করোনা সংকটে দিশেহারা মানুষ। আতংকিত নগরবাসী। বিপর্যন্ত জনজীবন। অর্থনীতির চাকা মন্থর। ঘুরে দাড়ানোর লড়াইয়ে লিপ্ত দেশের শিল্প-বানিজ্যখাত। দিনদিন কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ঈদের পশুহাট আক্রান্ত ও মৃত্যুর শঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অদক্ষতা আর সীমাহীন দুর্নীতি চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশুহাটের অনুমতি দেওয়া হলেও হাটবাজারে তা মানার কোন গরজ তেমন একটা চোখে পড়ছে না। গ্রামের মৌসুমী পশুহাটের অবস্থা তো আরো নাজুক। ক্রেতা বা বিক্রেতা কারো মাঝেই স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে সংক্রমণরোধে ঈদের আগে-পিছে গণপরিহন বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও তা আর হচ্ছেনা। ফলে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা থেকেই প্রায় ৩০/৩৫ লক্ষ মানুষ ঈদ উদযাপনে গ্রামে ফিরে যাবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন ব্যবহার হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ঈদুল ফিতরের ঈদের অভিজ্ঞাতা কিন্তু মোটেই সুখকর ছিলো না। অন্যদিকে করোনাকালের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও সাম্প্রতিক বন্যা গ্রামীণ অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে লণ্ডভণ্ড দেশের উপকূলবর্তী দক্ষিনাঞ্চল। বাঁধভেঙ্গে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। বহুমানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গতকারণেই তাদের জন্য এবারের ঈদ নিরানন্দ হবে তা বলাই যায়। এদিকে দেশের বহু জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ক্ষেতের ফসল নষ্ট। কৃষক দিশেহারা। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে গোবাদী পশুর খামারীরা। গো-খাদ্যের সংকট তীব্র হয়েছে। এবার হাটবাজারে গরুর দাম তুলনামূলক কম। খামারীরা লোকসানের শংকায় উদ্বিগ্ন। যখন দেশের খামারী ও কৃষক পশুবিক্রি করা নিয়ে চিন্তিত, লোকসানের শঙ্কায় শঙ্কিত, তখন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চোরাইপথে ভারত ও মায়ানমার থেকে বিনা বাধায় গরু নিয়ে আসছে। সীমান্ত লাগোয়া হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে চোরাই ভারতীয় গরু। সংকটে ও লোকসানের ঝুঁকিতে দেশের খামারী ও কৃষক। বিএসএফ দেখেও না দেখার ভান করছে। অথচ তারা কারণে অকারণে আমাদের দেশের নিরিহ মানুষকে গুলিকরে হত্যা করলেও এখন কিন্তু চোরাকারবারিদের প্রতি গুলি ছোড়ার পরিবর্তে সহনাভূতিশীল আচরণ করছে। সংকটকালীন সময়ে দেশীয় খামারীদের বাঁচাতে পশু চোরাচালান কঠোরহস্তে বন্ধ করা দরকার। আবহাওয়াবীদদের মতানুসারে এবারের বন্যা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট আরো প্রকট হবে।

আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, দেশে বহুমানুষ চাকরি হারিয়ে এখন গ্রামে। তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেন্জ। এমনিতেই করোনার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এর মধ্যেই নতুন করে যোগ হয়েছে বন্যা। দিশেহারা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক স্হিতিশীলতার জন্য গ্রামীন অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা জরুরী। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন খাত খুঁজে বের করা অত্যাবশ্যক।

কৃষির পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি। ক্ষুদ্রঋণ কার্য়ক্রমকে সহযোগিকরণ করার মধ্যদিয়ে গ্রামীণ জনপদে অর্থপ্রবাহের গতিকে সচল রাখতে হবে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর খুব একটি ভাল অবস্থায় নেই। তাই তারা ইচ্ছে থাকা সত্বেও কৃষিঋণ ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এমন প্রেক্ষাপটে মাইক্রো-ক্রেডিড ও এসএমই খাতই হতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা বা সচল রাখার অন্যতম হাতিয়ার।

করোনাকালে দেশের মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছে। বহুমানুষ গরীব হয়ে গেছে। আয় কমে গেলেও ব্যয়ের পরিমাণ একই রয়ে গেছে। সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ ও শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যকে। চলমান বন্যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবছর বন্যা জ্বলোচ্ছাস ও ঘুর্ণিঝড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। বলতে গেলে, এসবের সাথেই আমাদের বসবাস। তাই বন্যা, ঝড় জ্বলোচ্ছাস মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কর্মপন্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। বন্যাকালীন সরকারি-বেসরকারি সাহায্য অপ্রতুল। বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা সঠিকভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা না গেলে গ্রামীণ জনপদের অর্থনৈতিক সংকট আরো তীব্রতর হবে।

ইদানিং কুরবানি নিয়ে যত কথা হয় তার চেয়ে বেশি কথা হয় কুরবানির গোসত বন্টন নিয়ে, হাটে-বাজারে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি হচ্ছে না তা নিয়ে। এমনিতেই করোনার সামাজিক সংক্রমণ নগরজীবনের কোলাহলকে অনেকটাই স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার উপর কুরবানির পশুহাট সংক্রমণের ঝুঁকিকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিভাগের অসুস্থ্যতা জনমনে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। রিজেন্ট, জেকেজি, সাহাবুদ্দীন হাসপাতালের করোনা কেলেংকারীর আলোচনা ও সমালোচনা সমাজে তুঙ্গে তখন সরকারদলীয় এক নেত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিএসএমএমইউ’র চিকিৎসকদের জন্য নিম্নমানের মাস্ক সরবাহের ঘটনা জাতিকে হতাশ করেছে।

মানুষ খুব অসহায় হলে সেবা নিতে চিকিৎসা কেন্দ্রে যায়। ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়। প্রান্তিক জনপদের অধিকাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে থাকে। করোনাকালে হাসপাতালগুলোর ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা জনসস্মুখে চলে আসায় ভবিষ্যতে সেবাপ্রাপ্তি নিয়ে একপ্রকার অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে।

যাক সে সব কথা, বলছিলাম যেকোনো ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হল আল্লাহর দেওয়া নিয়ম-নীতি ও পন্থা অনুসরণ করে তা প্রতিপালন করে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। একই কাজ অথচ পদ্ধতি ভিন্ন হলে ইবাদত কুফরিতেও পরিণত হতে পারে। যেমন অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থে কুরবানি দিলে তা কবুল হবে না। অর্থাৎ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতাই ইবাদত নয়, হতে পারে না। বরং ইবাদতের মুল উদ্দেশ্য হলো দু’টি। প্রথমত যেকোনো কাজ ইসলাম নির্দেশিত পথে পালন করা, দ্বিতীয়ত আল্লাহর সন্তুষ্ট অর্জন।

তাই সংকট ও দুর্যোগের মধ্যে হতে যাওয়া কুরবানি যেন শুধু গোসত খাবারের উৎসবে পরিনত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যে কথা বলছিলাম, করোনাকালে আমাদের দেশের কিছু কিছু মানুষের মধ্যে অতি মুনাফা অর্জনের লোভ খুব নির্লজ্জভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ভুয়া করোনা টেস্টের ফলে জাতি হিসেবে বহিঃবিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি দারুনভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। গতবছর এতিমের হক কুরবানির পশুচামড়া নিয়ে যা হয়েছে তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখন থেকেই প্রস্ততি নিতে হবে। কোনভাবেই যেন দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা এতিমের হক পশুচামড়ার টাকায় ভাগবসাতে না পারে সে বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। দেশের কওমি মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোডিং ও এতিমখানার ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পশুরচামড়া থেকে অর্জিত হয়ে থাকে।

তাই আসুন সংকট ও দুর্যোগকালীন সময়ে হতে যাওয়া শতাব্দীর ব্যতিক্রম পরিবেশের ঈদে সবাই ত্যাগের মহান শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে দেশগঠনে আত্ননিয়োগ করি। দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে সকল প্রকার অনিয়ম, দূর্নীতি থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখি।

লেখক: প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।