রাজশাহীর প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ রক্তে লাল হয়ে ছিল পুলিশ লাইন

 

ওয়ালিউর রহমান বাবু :

২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর সাহসী ছাত্রনেতা কাজী আরিফ ঢাকার পিলখানা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) হেডকোয়াটারে থাকা রাজশাহী জেলা সদরের কাজীহাটা পাড়ার জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শওকত আলীর (শহিদ) কাছে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ম্যাসেজ ও অডিও পৌছে দেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যা শুরু করলে তিনি তার ওয়ারলেসর ব্লাকসেটে সেটি প্রচার করেন। দুই পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।

২৬মার্চ ভোরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী কলেজের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্রনেতা এম.এল.এ নাজমুল হক সরকারকে রাজশাহী মহিলা কলেজের পাশের রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায়। স্বাধীনতাকামীরা বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশের কাছে গিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালি পুলিশদের আত্মসমর্পণ করতে বললে তাদের প্রতিরোধে সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। এ খবর শুনে রাজশাহী কলেজের ছাত্রনেতারা বাঙালি পুলিশদের সহযোগিতা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যান্যদের নিয়ে সেখানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।

বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে সেখানে খাবার সরবরাহ করা হয়। পরের দিন ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার সেখানে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলে ব্যর্থ হয়ে চুক্তি করে ‘কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না’ কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করে তারা রাজশাহী ডিআইজি মামুন মাহমুদকে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিগ্রেডিয়ার কথা বলবেন বলে, ডেকে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেন নি। গির্জার কাছে ব্যারিকেড দিতে গিয়ে কাটু নামে একজন শহিদ হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণের সময় বেঁধে দেয়।

এ পরিস্থিতি জানিয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক রশীদুল হাসান ও পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ (শহিদ) নওগাঁ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ই.পি.আর) ৭নং উইং এ যোগাযোগ করেন। সময় দুরুত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭নং সেক্টর, ৪নং সাবসেক্টর কমান্ডার) ওই মুহুর্তে সহযোগিতা করতে না পারলেও দ্রুত অ্যাডভান্সের কথা জানান।

স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আওয়ামীলীগের জেলা ট্রেজারার অবাঙালি নেতা হাফেজ আবদুস সাত্তারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস হেডকোয়ার্টারে (ই.পি.আর) থাকা অবাঙালি সৈনিকরা হেডকোয়ার্টার ছেড়ে ক্যান্টমেন্টে চলে যায়। সন্ধ্যার পর অবাঙালি ক্যাপ্টেন ইসহাক বাঙালি ই.পি.আরদের সরে যেতে পরামর্শ দিলে হাবিলদার রাজ্জাক, হাবিলদার নিজামুদ্দিন, নায়েক ইসরাইল প্রমুখের নেতৃত্বে বাঙালী ই.পি.আররা ম্যগজিন রুম থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নেন। অবাঙালি সুবেদার মেজর আহমেদ খান, হাবিলদার বালা খান বাঙালি ই.পি.আরদের উপর আক্রমণ করতেই বাঙালি ই.পি.আরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে সেখান থেকে সরে যায়। অবাঙালি অফিসাররা সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছেড়ে জেলা পরিষদ ডাক বাংলো, সার্কিট হাউজে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস হেডকোয়ার্টার, আনসার ক্যাম্প, পুলিশ লাইনে সেলিং করতে থাকে।

তাদের সিলিং এ পুলিশ লাইনের পাশে অ্যাডভোকেট মোক্তার হোসেনের ছেলে প্রতিবেশী সহ চারজন তাদের বাড়ির ট্রেঞ্চে শহিদ হন। তারা ই.পি.আর হেডকোয়ার্টার ও আনসার ক্যাম্প ধ্বংশ করে বেতার কেন্দ্র অকেজো করে দেয়।

রাজশাহী কলেজের ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা পাড়া মহল্লার স্বাধীনতার কামীদের সাথে পরামর্শ করে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। বেশ কিছু তরুণ, ছাত্র, যুবক পুলিশ বাহিনীর নিষেধ উপেক্ষা করে, তাদের সাথে থেকে গিয়ে প্রতিরোধে সহযোগিতা করে। কোর্ট অঞ্চলে মিজান চৌধুরী নামে একজনের কথা শোনা যায়। ২৮মার্চ দুপুরে ২৫ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ান পাবলিক হেলথ অফিসের ছাদে অবস্থান নিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে অস্ত্র তাক করে। তাদের আরেকটি গ্রুপ পূর্ব দিক দিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে টার্গেট করে। দক্ষিণ দিকে কোন প্রতিরোধ না থাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা সুযোগ নেয়। সেনাবাহিনীর এক অফিসার আসার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় সেলিং ও গুলি। ভেঙ্গে গেল পুলিশ লাইনের ওয়ারলেস টাওয়ার। শহিদ হলেন পাশের পাড়ার গোলাম মোস্তফা সহ কয়েকজন।

পুলিশ লাইনের ভিতর থেকে পিস্তলের গুলির শব্দ হতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি ছোড়া বন্ধ করে চার্জ বলে একসাথে ভিতরে প্রবেশ করে। স্বাধীনতাকামী পুলিশ বাহিনী ৩০৩ রাইফেল ব্যবহার করে ব্যর্থ হল। রক্তে লাল হয়ে গেল পুলিশ লাইন চত্তর। শহিদ হলেন এসআই এনায়েত খান, কনস্টেবল ১০০আব্দুর রাজ্জাক, কনস্টেবল ২২০ওসসমান খান, কনস্টেবল ২২৮আব্দুল হামিদ, কনস্টেবল ৪৬৪ আব্দুল আজিজ, কনস্টেবল ৫৯৭আব্দুল মালেক, কনস্টেবল ৯৫ মেছের উদ্দীন, কনস্টেবল ১০১৩জয়নাল আবেদিন, কনস্টেবল ১১০২আবু ইলিয়াস, কনস্টেবল ১১৪২আক্কাস আলী, কনস্টেবল ১১৭৮আব্দুর রহমান, কনস্টেবল ১২৮২রইস উদ্দীন, কনস্টেবল ১৩০১আলাউদ্দীন, কনস্টেবল ১৪০২আব্দুল আজিজ মোল্লা, কনস্টেবল ১৪৩৪সাদেকুল ইসলাম, কনস্টেবল ১৪৭৭সিরাজুল ইসলাম, কনস্টেবল ২১৮৪আলীম্দ্দুীন, পুলিশ লাইনের স্টাফ ইউসুফ, সাজ্জাদ সহ অনেকে। সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি পুলিশ লাইনের ভিতরে ঢুকে বেরিয়ে যাবার পর রাজশাহী কলেজের ছাত্রনেতারা অন্যান্যদের সাথে সেখানে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করে নেন। রাজশাহী ক্যান্টমেন্টে অ্যাকশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রয়োজন হল, একজন চৌকশ রণকৌশলবিদের। বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হল।

বিকেলের ছুটিতে আসা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুবেদার বেসারত উল্লাহ ( বীর মুক্তিযোদ্ধা) ও কমান্ডো ওস্তাদ হারুনওর রশীদ খান (বীর মুক্তিযোদ্ধা) কোর্টের পশ্চিমে বসরীর ইটভাটায় প্রতিরোধ গড়ে তুললে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ৩১ মার্চ রাজশাহী জেলা প্রশাসকের বাসভবন থেকে আলোচনার নামে পাকিস্তানি সৈন্য পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদকে (শহিদ) তার পকেটে থাকা রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে পরিবারের সামনে থেকে নিয়ে গেলে তিনি আর ফিরে আসেন নি। তথ্যসূত্র: বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব উদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার আবদুল মান্নান, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা বেসারত উল্লাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশীদ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রনেতা মাহফুজার রহমান খান, ছাত্রনেতা, শহিদ পরিবার।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক, রাজশাহী, ০১৯১১৮৯৪২৬০