শাসক হয়েও বিনয়ী যাঁরা

মহানবী (সা.)-এর পর ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে সোনালি অধ্যায় গণ্য করা হয় ‘খোলাফায়ে রাশিদিনে’র শাসনকালকে। মহানবী (সা.)-এর বিশিষ্ট চারজন সাহাবি এই সময় ইসলামের রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যাঁরা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও ছিলেন একান্ত বিনয়ী। ঠিক যেমনটি পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় প্রভুর বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে বিনয়ী হয়ে চলাফেরা করে এবং যখন তাদেরকে মূর্খরা সম্বোধন করে তারা বলে সালাম।’ (সুরা ফোরকান, আয়াত : ৬৩)

আবু বকর সিদ্দিক (রা.) : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মদিনার এক অন্ধ নারীর ঘরের কাজ করে দেওয়ার ইচ্ছা করেন। তিনি গিয়ে দেখলেন তাঁর আগেই কেউ সেখানে উপস্থিত হয়েছেন এবং অসহায় বৃদ্ধার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করেছেন। ওমর (রা.) তাঁর কাছে পৌঁছার পর দেখলেন তিনি মুসলিম বিশ্বের খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। (আল কামিল ফিত-তারিখ : ১১২৯)

উসামা বিন জায়েদ (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে বিদায় জানাতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাদের সঙ্গে বের হন। এই বাহিনী শাম অভিযানে বের হয়েছিল। আবু বকর (রা.) পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আর উসামা (রা.) ছিলেন বাহনের ওপর। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! হয়তো আপনি বাহনে উঠুন অথবা আমি নেমে যাই। আবু বকর (রা.) বললেন—আল্লাহর কসম! তুমি নামবে না আর আমিও আরোহণ করব না। কেন আমি কিছু সময় আল্লাহর রাস্তার ধুলো-বালি পায়ে মাখব না। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাস্তার যোদ্ধারা যতক্ষণ চলতে থাকে তাদের প্রতি পদক্ষেপে সাত শ নেকি লেখা হয়, সাত শ মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় আর সাত শ পাপ মার্জনা করা হয়। (তারিখে তাবারি : ২/৪৬২)

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) : আবু মাহজুরা (রা.) বলেন, আমি ওমর (রা.)-এর সঙ্গে বসে ছিলাম। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া একটি ঝুড়ি নিয়ে এলেন—যা আবা পরিহিত একজন দাস বহন করছিল এবং ওমর (রা.)-এর সামনে রাখলেন। তিনি আশপাশের দরিদ্র মানুষ ও দাসদের ডেকে আনলেন এবং তাদের সঙ্গে খেলেন। অতঃপর বললেন, আল্লাহ সেই জাতির নিন্দা করেছেন যারা দাসদের সঙ্গে খেতে অপছন্দ করেন। সাওফান (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি তাদের অপছন্দ করি না, তবে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাই। আল্লাহর কসম! কোনো ভালো খাবার পেলে আমি খাই এবং তাদেরও খেতে দিই।’ (হায়াতুস সাহাবা : ৩/৪৬৮)

উরওয়া ইবনে জোবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কাঁধে পানির মশক দেখলাম। আমি বললাম, হে আমিরুল মুমিনিন! এটা আপনার জন্য শোভনীয় নয়। তিনি বললেন, বিভিন্ন দল আমার কাছে অনুগত ও বিনয়ী হয়ে উপস্থিত হয়—যা আমার অন্তরে আত্মমুগ্ধতা তৈরি করে। আমি তা কমাতে চাই। তিনি পানির মশক নিয়ে একজন আনসারি নারীর ঘরের কাছে গেলেন এবং তার পাত্রে পানি ঢেলে দিলেন।’ (আমিরুল মুমিনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা ১৯১)

উসমান ইবনে আফফান (রা.) : হামদানি (রহ.) বলেন, আমি উসমান (রা.) ও তার গোলাম নায়িলকে একই খচ্চরের ওপর বসা দেখেছি। অথচ তিনি তখন খলিফা। (হুলয়াতুল আউলিয়া : ১/৩১) হাসান বসরি (রহ.) বলেন, আমি উসমান ইবনে আফফান (রা.)-কে খলিফা হওয়ার পর মসজিদে কায়লুলা (দুপুরের খাওয়ার পর বিশ্রাম) করতে দেখেছি। তিনি যখন উঠলেন, তখন তাঁর পিঠে পাটির দাগ বসেছিল। তিনি বলেন, আমরা বললাম, ইনি হলেন আমিরুল মুমিনিন, ইনিই আমিরুল মুমিনিন। (সাফওয়াতুস সাফওয়া : ১/১১৮)

আলী ইবনে আবি ‘তালিব (রা.) : মুহাম্মদ ইবনে হানিফা (রহ.) বলেন, আমি আমার দাদা (আলী ইবনে আবি তালিব)-কে জিজ্ঞাসা করি, রাসুল (সা.)-এর পর সর্বোত্তম মানুষ কে? তিনি বললেন, আবু বকর (রা.)। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, ওমর (রা.)। আমি বললাম, তারপর কে? বর্ণনাকারী বলেন, আমার ভয় হলো, তিনি হয়তো উসমান (রা.)-এর নাম বলবেন। আমি বললাম, এরপর কি আপনি? তিনি বললেন, আমি তো একজন সাধারণ মুসলিম। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৬৭১) এক ব্যক্তি আলী (রা.)-কে একটি মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করল। তিনি সমাধান দিলেন। লোকটি বলল, হে আমিরুল মুমিনিন! বিষয়টি এমন নয়; বরং এমন এমন। আলী (রা.) বললেন, তুমি ঠিক বলছ, আমি ভুল বলেছি। নিশ্চয়ই প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর মস্ত জ্ঞানী রয়েছে। (আখবারুল কুদাত : ১/২৬৭)

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ