রাজশাহীতে সমন্বিত মাছ চাষ, মুখে হাসি চাষিদের

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বৈলসিং গ্রামের বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক আলাফ মোল্লা। প্রায় ১৫ বছর ধরে করছেন মাছচাষ। বাড়ির পাশে বিলের মধ্যে রয়েছে তার পাশাপাশি চারটি বিশালাকার পুকুর। কানো কোনোটি পুকুর নয়, যেন দিঘী। আয়তনে ১৫-২০ বিঘা জলাকর। তবুও এসব জলাধারকে এখন পুকুর নামেই ডাকেন স্থানীয়রা। এখন নতুন করে আর কোনো জলাধারকে দিঘী বলে ডাকাও হয় না। তাই হয়তো এগুলো নাম হয়েছে পুকুর।

অথচ ২০-৩০ বছর আগে হলেও এসব জলাধারকে দিঘী বলেই চেনা হত। পুকুর না হয় দিঘী- যাই বলি না কেন, আলতাফ মোল্লার এই জলাধারগুলো থেকে উৎপাদিত মাছ বিক্রি করেই তিনি আজ কোটিপতি। তার পুকুরের মাছগুলো চলে যায়, গাড়ীতে করে সরাসরি ঢাকায়। বলা যায়, পুকুর থেকে তাজা মাছ ধরে সেই অবস্থায় ট্রাকে করে বিশেষ কায়দায় পাঠানো হয় ঢাকায়। আর ঢাকাতে বসেই সেখানকার ভোক্তারা বাজার থেকে কিনে খেতে পাচ্ছেন তাজা মাছ। কোনো কোনো পুকুর পাড়ে বনজ জাতের গাছের বাগানও তৈরী করে দেওয়া হয়েছে।

শুধু আলতাফ মোল্লার পুকুর থেকেই নয়, রাজশাহীর এইরক হাজার হাজার মাছচাষির পুকুর থেকেই এখন তাজা মাছ চলে যাচ্ছে ঢাকার বাজারে। মাঝে মাছে ফরমালিন নিয়ে ব্যাপক হৈ-চৈ পড়ে যায় সারা দেশে। কিন্তু এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে পুকুরের তাজা মাছ। এতে করে ফরমালিনের এখন আর কোনো বালাইও থাকছে না। ফলে দিন দিন তাজা মাছের চাহিদাও বাড়ছে ব্যাপক হারে। আর সেই চাহিদার বড় একটি অংশ যোগান দিচ্ছেন রাজশাহীর মাছচাষিরা। আবার পুকুর পাড়ের বাগান থেকে আম, পেয়ারা, বরই এবং হাঁস-মুরগির চাষ করে বাড়তি আয়ে কপাল খুলছে চাষিদের।

ইদানিং মাছচাষের পাশাপশি পুকুর পাড়ে নানা ধরনের ফলসহ সবজি এমনকি হাঁস-মুরগিরও চাষ করছেন মাছচাষিরা। যাকে বলা হচ্ছে সমন্বিত মাছচাষ। আলতাফ মোল্লার পুকুর পাড়েও গড়ে তোলা হয়েছে পেয়ারা এবং কলা বাগান। পাশাপাশি রয়েছে হাঁসের চাষ। যাতে করে মাছে পাশাপাশি পেয়ারা, আম, কলা, বরই গাছসহ হাঁস এবং মুরগি থেকে আসছে বাড়তি অর্থ।

কেউ কেউ সবজি চাষও করছেন পুকুরপাড়ে। এতে করে বাড়তি সবজির ফলনও হচ্ছে। সেই সঙ্গে হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ। গড়ে উঠছে নতুন নতুন পুকুর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধানের জমি কেটে আশঙ্কাজনক হারে গড়ে উঠছে পুকুর। এতে করে মাছের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে ধানের পরিমাণ কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।

জেলা মৎস্য সম্পদ অধিদফতর সূত্র সিল্কসিটি নিউজকে জানায়, রাজশাহীতে বার্ষিক মাছের চাহিদা ৫৩ হাজার ৯৯৩ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৬৬ হাজার ৮২২ মেট্রিন টন। ফলে উদ্বৃত্ত থাকে ১২ হাজার ৮৮৯ মেট্রিক টন। মোট জলাশয়ের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে সরকারি পুকুর ও দিঘি আছে ৪ হাজার ৯১৫টি। এ ছাড়া আছে ৩৬ হাজার ৯৬১টি পুকুর ও দিঘি।

তাছাড়া মাছচাষ হয় ধানখেতে, বিল এবং নদীতে। মোট মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১১ হাজার ৮৬৬ জন। আর মাছচাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে নতুন করে এসব হিসেবের সঙ্গে আরো অন্তত ১ ভাগ অতিরিক্ত যোগ হবে বলে মনে করছেন মৎস কর্মকর্তারা।

তাঁদের মতে, ইদানিংকালে রাজশাহীতে অন্তত ১০ ভাগ নতুন পুকুর খনন হয়েছে। যেসব পুকুরের কারণে মাছের উৎপাদনও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে উদ্বৃত্তও থাকছে বেশি। যেগুলো চলে যাচ্ছে ঢাকায়।

বাগমারার আলতাফ মোল্লাহ জানান, তার পুকুরে বছরে তিন-চার বার মাছ ছাড়া হয়। আবার সমপরিমাণ সময়েই মাছ ধরা হয়। প্রতিবারই পুকুরে মাছ দেওয়া হয় ৫০০ গ্রাম থেকে শুরু করে দেড় কেজি ওজনের পর্যন্ত। এগুলো ৪-৫ মাসে আকার ধারণ করে দুই কেজি থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত। যা বাজারজাত করে লাভ হয় খরচের অন্তত ২৫ ভাগ। তবে পুকুর পাড়ে যেসব ফলদগাঝ রয়েছে, সেগুলো থেকে বাড়তি আয় হয়। ফলে লাভের পরিমাণও বাড়ে।

আলতাফ মোল্লা বলেন, ‘গত ১৫ বছরে মাছচাষ করে আমি অন্তত কোটি টাকা আয় করেছি। পাশাপাশি বেশকিছু লোকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়েছে। আমার দেখাদেখি এই এলাকায় আরো অন্তত শতাধিক যুবক মাছচাষে উদ্বুদ্ধও হয়েছেন। তারাও এখন আয় করছেন। নিজের বেকারত্বও ঘুঁচিয়েছেন অনেকেই।’


রাজশাহীর দুর্গাপুরের মাছচাষি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম সাকলায়েন জানান, তাঁর বর্তমানে ২২টি পুকুর আছে। কোনো কোনোটি পুকুরের আয়তন ৬০ বিঘাও রয়েছে। তিনিও প্রায় ২০ বছর ধরে পুকুরে মাছচাষ করে যাচ্ছেন। তবে আগের মতো এখন আর মাছচাষে তেমন লাভ হয় না। তারপরেও পুকুর পাড়ে যেসব ফলদজ গাছ রয়েছে-তাতে লোকসানও হয় না। বছর শেষে কিছু টাকা হলেও পকেটে ঢুকে। পুকুর দেখা-শোনার সঙ্গে নিয়োজিত শ্রমিকসহ মাছ ধরা থেকে শুরু করে বাজারজাতকাজের পেছনে জড়িত থেকে অনেক লোকের আত্মকর্মসংস্থানেরও সুযোগ হচ্ছে। কাজেই মাছচাষ এই অঞ্চলের এখন প্রধান আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে।’

দুর্গাপুরের বর্দ্ধনপুর গ্রামের আরেক বড় মাছচাষি এছরাফ আলী জানান, তাঁরও অন্তত ২০টি পুকুর রয়েছে। পুকুরে মাছ উৎপাদনের জন্য এরই মধ্যে নিজেই একটি মাছের খাবারের মিল তৈরী করেছেন। তাঁর দেখাদেখি ওই এলাকায় আরো কয়েক শ যুবক মাছচাষে নেমে পড়েছেন। যাদের অধিকাংশই আগে ছিলেন বেকার।

এসব মাছচাষিরা সমন্বিত মাছচাষ করছেন। ফলে দুর্গাপুরের পুকুরপাড়গুলোতে গড়ে উঠেছে নানা জাতের গাছপালাসহ সবজি বাগানও। সঙ্গে চাষ হচ্ছে হাঁস ও মুরগিও।

রাজশাহী জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পবা উপজেলার পারিলা এলাকার মাছচাষি সোহরাব হোসেন বলেন, ‘আমরা এর আগে সনাতন পদ্ধতিতে মাছচাষ করতাম। তবে গত ১০ বছর থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছচাষ করছি। কারণ, নিরাপদ বিষমুক্ত মাছচাষ করতে হলে সনাতন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ’

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র শাহা বলেন, রাজশাহীতে মাছচাষে বিপ্লব ঘটেছে। আগের চেয়ে অন্তত ১০ ভাগ পুকুরের সংখ্যা বেড়েছে। তবে দানি জমি কেটে এসব পুকুর করা হয়েছে। এতে করে ধান উৎপাদনের পরিমাণ কমলেও বাড়ছে মাছের চাষ। মাছচাষ করে অনেকেই আত্মসাবলম্বি হচ্ছেন। বিশেষ করে সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছচাষ করে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। এসব মাছ চলে যাচ্ছে ঢাকার বাজারে। কারণ এককেজি মাছ উৎপাদন করতে যে টাকা খরচ হয়-তা রাজশাহীর ভোক্তাদের নাগালের বাইলে। ফলে এসব মাছ ঢাকায় বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে চাষিরা।’

তিনি আরো বলেন, মাছের পাশাপাশি পুকুর পাড়ে ফলদ ও বনজ গাছ লাগিয়েও বাড়তি অর্থ আয় করছেন চাষিরা। কোথাও কোথাও হাঁসের চাষও হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে নতুন নতুন আয়ের দিক উন্মোচন হচ্ছে। এই অঞ্চলের অর্থনীতিও সমৃদ্ধিশালী হচ্ছে।’

স/আর