রাজশাহীতে ‘ভালোবাসা’ দিবসে ‘ভালোবাসা’ বিলাচ্ছেন ওরা

হারুন-অর-রশিদ রিহান:

হিজড়া জনগোষ্ঠী কারো কাছে বিরক্তিকর আবার কারো কাছে আতঙ্কের কারণ। তাদেরকে অবজ্ঞা করে না বা আঁড়চোখে দেখেন না এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সব জায়গায় অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার এই মানুষগুলো যাদেরকে আমরা চিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা হিজরা নামে।

তাদেরকে এড়িয়ে চলায় শ্রেয় মনে করেন নারী বা পুরুষ হিসেবে পরিচিত সমাজের অন্যান্যরা।
এমনকি লোকলজ্জার ভয়ে একসময় পরিবারও হিজড়া সন্তানকে বোঝা মনে করে আর তখনই পরিবার থেকে পালিয়ে যেয়ে মুক্তি মেলে হিজরা জীবনের।

পার্ক, রাস্তা ও গণপরিবহণে রয়েছে হিজড়াদের সরব উপস্থিতি। মুখের সামনে অতর্কিত ভাবে হাত বাড়িয়ে অথবা গায়ের উপরে প্রায় পড়ি-পড়ি হয়ে তারা টাকার আবদার করেন। নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণীকে একত্রে পেলেই তাদেরকে হিজড়ারা স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা সাজিয়ে রসালো মন্তব্য ছোঁড়েন এবং টাকা আদায় করেন। আর টাকা না দিলে অশ্লীল ভাষায় চেঁচামেচি আর সাধারণ মানুষের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটে অনেক। গণমাধ্যমেও এসেছে তাদের চাঁদাবাজির নানা খবর।

তবে এসব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে এবং অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত না থেকে সমাজের চোখে আঙুল দেখিয়ে স্বপ্নের অন্য রকম এক জীবন গড়ছেন রাজশাহীতে দুজন তৃতীয় লিঙ্গের মিস প্রিয়া ও মিস রত্না ।

সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার এলাকার পদ্মা গার্ডেনে দেখা মেলে তাদের। পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে ঢাকি হাতে ফুল বিক্রি করছেন। সাধারণ মানুষকে উতক্ত বা আতঙ্কিত না করে বিনয়ী ভাবে ফুল বিক্রি করছেন তারা।

তাদেরই একজন রাজশাহীর টিকাপাড়া এলাকার মিস প্রিয়া। তিনি দিনের আলো হিজড়া সংঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট।

মিস প্রিয়া জানান, ‘প্রকৃতিগতভাবে এমনভাবে জন্ম নিয়েছি। আমার কী দোষ। একটা সময় মানুষের কাছে জোর করে টাকা নিতাম। এখন আর মানুষকে আক্রমণ করে টাকা নেয় না। এখন নিজে কর্ম করি। বাড়ির খরচ জোগাড় করে আমার মাকে নিয়ে থাকি। আমি অন্য হিজড়াদেরও কর্ম করে খেতে বলি। নতুন ভাবে বাঁচতে চায়। বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফুল বিক্রি করছি। প্রতিটি তাজা ফুল মাত্র ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি করছি। অনেককে ফ্রিতেও দিচ্ছি। আমরা চাই সাধারণ মানুষ আমাদের গ্রহণ করুক। অনেক হিজড়ার দল আমাকে তাদের সঙ্গে এখনও নিয়ে যেতে চায়। তারা চায় তাদের মতো ভিক্ষাবৃত্তি ও অসাধু উপায়ে উপার্জনের জন্য। কিন্তু আমি এখন আর রাজি না।

তিনি আরো জানান, ‘আগের দিনগুলো আমার ছিল অনেক কষ্টের। যেখানে যেতাম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো। এখন আর তা হতে হয়না। আমাদের সমাজ মেনে নিয়েছে। মানুষ আমাদের কাছে ডাকে কথা বলে।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সমাজে আমাদের সমঅধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
অথচ কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই আমাদের। পারিবারিকভাবেও আমরা অনেকে উপেক্ষিত। কোনো আশ্রয় নেই। আর সে কারণেই দলগতভাবে আশ্রয় খোঁজেন হিজড়ারা। তবে সমাজের সুযোগ সুবিধা আরও বাড়ালে সবাই কর্ম করে খেতে পারবো।’

এমন আরও একজন হলেন মিস রত্না। তিনি বড়কুঠি এলাকায় থাকেন। এক বছর ধরে বিভিন্ন রকমের কর্মে যুক্ত রয়েছেন। পরিবার ও সমাজের ধারণা পাল্টে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা হিজড়াদের একজন তিনি।

তিনি বলছিলেন, ‘আমি কাজ করে খাই। ভিক্ষা করি না। মানুষের খারাপ কথা তোয়াক্কা করি না, চলতে শিখেছি নিজের পায়ে। কিছুদূর পর্যন্ত পড়েছি। ভালো চাকরি পেলে করতে চাই। এখন দিনের আলো হিজড়া সংঘ থেকে কিছুটা টাকা পাই, তবে কর্ম করে খেয়ে যে সম্মান পাই তার মূল্য কোটি টাকার বেশি। দিনে আমরা এখন ৫০০-৬০০ টাকার ফুল বিক্রি করি। বাসায় বড় বোন ও মাকে নিয়ে থাকি। যা উপার্জন করি তা দিয়ে সংসার চলে যায়। তবে এই মাসে কিছু দিবসকে কেন্দ্র করে ভালো লাভ হয়েছে। এখন থেকে ভালো কাজের সাথে থাকতে চাই।

তিনি আরো বলেন, ‘ বর্তমানে হিজড়াদের বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ আর নানা সাহসি কর্মকাণ্ড এই ধারণা ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে। আমাদের অনেকে এখন কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অনেকেই নতুন করে ভাবছেন এখন আমাদের নিয়ে ।’

জি/আর