রাজশাহীতে ডেঙ্গু জয় করে বাড়ি ফিরলো সাড়ে সাত মাসের শিশু


রফিকুল ইসলাম

মাত্র সাড়ে মাস বয়স তার। এই বয়সে ডেঙ্গুর মতো একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল শিশুটি। তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলো সে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এতোটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে বাবা-মা প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে বাাঁচানোর জন্য আইসিইউতে নেওয়া হয়। এর পর টানা ৬দিন ইনসেটিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) থাকার পর অবশেষে গতকাল শনিবার দুপুরে বাসায় ফিরে গেছে সেই শিশুটি।

বলা যায়, ডেঙ্গু জয় করে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়ে বাসায় গেল শিশুটি। নাম তার সাবা খাতুন। বাড়ি নগরীর জাউতলা এলাকায়। সে ওই এলাকার বাসিন্দা রাজু হাওলাদারের ছেলে। সাবার মা মহসিনা খাতুন নিজেও একজন নার্স। তিনিও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে কর্মরত।

মা মহিসান খাতুন জানান, তিনি ঈদের আগের দিন তাঁর বাবার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বেড়াতে যান। সেখানে দুদিন থেকে গত ৩০ জুন আবার রাজশাহী শহরে চলে আসেন। মহসিনার দুই চাচাতো ভাই চাকরি করেন কুমিল্লায়। তাাঁরা একটি বেসরকারী কম্পানীতে চাকরি করেন। তাঁরাও এসেছিলেন ঈদ করতে।

মহসিনা জানান, তিনি দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার একদিন পরেই ছোট সন্তান সাড়ে সাত মাসের কন্যা শিশু সাবা খাতুন জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রথম দিকে স্বাভাবিক জ্বর মনে করেই নাপা শিরাপের মাধ্যমে সাবার শরীর থেকে জ্বর নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু কোনো মতেই জ্বর যাচ্ছিল না তার। এভাবে কেটে যায় কয়েকদিন। শেষে ৭ জুলাই সাবার অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যেতে থাকলে বাবা-মা তাঁকে নিয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে যান। শিশু বিশেষজ্ঞ ইকবাল বারী বিভিন্ন রকম পরীক্ষার দেওয়ার পাশাপাশি শিশুটির ডেঙ্গু পরীক্ষারও পরামর্শ দেন। এর পর পরীক্ষায় ধরা পড়ে শিশুটির ডেঙ্গু হয়েছে। ততক্ষনাৎ দেরি না করে শিশু সাবাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানেও আরও অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে তার। একপর্যায়ে শকে চলে যায় শিশুটি। চিকিৎসকরা আর দেরি না করে তাকে আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন। ৯ জুলাই শিশুটিকে যখন আইসিইউতে নেওয়া হয়, তখন তার পেটসহ হাত-পা ফুলে গেছিল। বুকের দুধও খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। নড়া-চড়াও বন্ধ করে দিয়েছিল।

চিকিৎসকরা তার শরীরে স্যালাইন পুশ করবেন কিন্তু সেটিও করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ওইদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে খবর দেওয়া হয় আইসিইউতে কর্মরত জ্যেষ্ঠ নার্স গীতা রানী সরকারকে। তিনি খবর পেয়ে রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালে এসে অনেক চেষ্টার পরে শিশুটির হাতে ক্যানোলা করতে সক্ষম হন। এর পর স্যালাইন শরীরে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পরে শিশুটি একটু নড়াচড়া করতে তাকে। তখন থেকে আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে থেকে ধিরে ধিরে শিশুটি সুস্থ হতে থাকে। অবশেষে গতকাল শনিবার দুপুরে শিশুটি ডেঙ্গু জয় করে বাবা-মার কোলে ফিরে যায়। সেই সঙ্গে মা-বাবার মুখে হাসি ফুটে তুলে বাড়ি ফিরে যায় শিশুটি।

শিশুটির মা মহসিনা খাতুন বলেন, ‘আমি নার্স হলেও আমি তো একজন মা। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যখন আমার শিশুটি শকে চলে যায়, তখন আমি যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তবে চিকিৎসকরা আমাকে সাহস দিতেন। আইসিইউ’র ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার আমাকে মানসিকভাবেও সাপোর্ট দিয়েছেন। তার পরেও আমার শিশুটি নিয়ে আমি প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইসিইউতে কোনো বয়স্ক রোগীকে নেওয়া হলেও তাঁর আশা ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে মাত্র সাড়ে সাত মাসের শিশু আদৌ বেঁচে ফিরবে কি না, সেটি নিয়ে আমরা সবাই শঙ্কায় ছিলাম। সেই শিশুকে আজ আবার কোলে তুলে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পেরেছি, এর চেয়ে খুশি আমার মতো আর কেউ নাই এখন।’

শিশুটির বাবা রাজু হাওলাদার বলেন, ‘সাবা আইসিইউতে থাকা অবস্থায় গত ১৩ জুলাই পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণ আমাদের কেটেছে শঙ্কায়। হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষা করেছি, আর বার বার খারাপ কোনো সংবাদের কথা ভেবে বুক কেঁপে উঠেছে। কিন্তু সেই শিশু বেঁচে ফিরে আসলো আজ। এখন খুব ভালো লাগছে।’

আইসিইউ’র ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন,  ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশুটির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এই অবস্থায় শিশুটিকে আমরা চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করতে পেরেছি। শিশুটিকে যেন নতুন করে জীবন ফিরে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। আমরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’

স/আর