মালয়েশিয়ায় বিদেশি শ্রমিকদের বৈধতা এবং আমাদের করণীয়

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মালয়েশিয়া সরকার সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশি শ্রমিকদের বৈধতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বর্তমান মাসের মাঝামাঝি বৈধতা প্রদান প্রক্রিয়া শুরু করারও ঘোষণা দিয়েছে। আর এই প্রক্রিয়া আগামী বছরের জুন পর্যন্ত চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে। কোনো অবৈধ শ্রমিক ওই সময়ের মধ্যে এই সুযোগ গ্রহণ না করে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করলে সে দেশের সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া কেউ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজের দেশে ফিরে গেলে তাদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হবে না।

মালয়েশিয়ার বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি হামজাহ বিন জায়নুদ্দিন এই ঘোষণাকালে জানিয়েছেন যে বৈধকরণ প্রক্রিয়ায় অবৈধ বিদেশি কর্মীরা সরাসরি মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন দপ্তর এবং শ্রম বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এই প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষের (এজেন্ট ও দালাল) কোনো প্রকার সংশ্লেষ থাকবে না। আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে যে শুধু নির্মাণ, উৎপাদন, প্লান্টেশন এবং কৃষি খাতের অবৈধ বিদেশি কর্মীরা এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে। উল্লেখ্য, এ খাতগুলোতে যেমন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ বিদ্যমান, তেমনি কাজগুলো কঠোর পরিশ্রমের ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই কাজগুলো স্থানীয় লোকজন করতে মোটেও আগ্রহী হয় না।

বৈধকরণের এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘আনডকুমেন্টেড মাইগ্রেন্ট রিক্যালিব্রেশন প্ল্যান’। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পরিকল্পনাটি সম্পর্কে সব তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দূতাবাস ও মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীদের সরবরাহ করবে এবং এটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য একযোগে কাজ করবে। তবে বৈধকরণের প্রক্রিয়াটি চলমান থাকাকালে বিদেশ থেকে কোনো কর্মী নিয়োগ দেওয়া যাবে না। খরচপাতির সম্ভাব্য অবস্থা থেকে ধারণা করা যায় যে অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশিদের বৈধ হওয়ার জন্য মোটামুটি ভালোই খেসারত দিতে হবে। অবশ্য খেসারত দেওয়াটা এরই মধ্যে তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। যা হোক, অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশি কর্মীরা যে দুশ্চিন্তা আর হয়রানি থেকে রেহাই পাওয়ার একটা সুযোগ পাচ্ছে, এটাই বড় কথা। এর ফলে তাদের পরিবারের লোকজনও অনেকটা স্বস্তি পাবে।

সংবাদটি নিঃসন্দেহে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান বা কর্মরত বিদেশিদের জন্য সুখবর। এ ধরনের পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়। মালয়েশিয়া সরকার এর আগে বেশ কয়েকবারই এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে কর্মকালে আমি অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশিদের বৈধকরণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমার সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা বলার জন্য এই লেখাটি।

২০১১ সালের জুলাই মাসে মালয়েশিয়া সরকার অবৈধভাবে সে দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের বৈধকরণের উদ্দেশে একটি ‘কম্প্রিহেনসিভ সেটলমেন্ট প্রগ্রাম (সংক্ষেপে সিক্স-পি)’ গ্রহণ করেছিল। ওই প্রগ্রামটি আগস্ট মাসে শুরু হয়ে তিন মাস চলার কথা থাকলেও সময়সীমা কয়েকবারই বাড়ানো হয়েছিল। প্রথমে পাঁচটি ক্ষেত্রের, যেমন—নির্মাণ, প্লান্টেশন, উৎপাদন, কৃষি বা খামার এবং সেবা খাতের কর্মীদের জন্য এই সুযোগের ঘোষণা দিলেও পরবর্তী সময়ে আরো ১০টি খাতকে যুক্ত করা হয়েছিল। যারা নিজ দেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, তাদের কোনো জেল-জরিমানা ছাড়াই যেতে দেওয়া হয়। তবে সেই প্রক্রিয়াটিতে তৃতীয় পক্ষ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা কর্মীদের রেজিস্ট্রেশন করার কাজটি করেছিল।

বৈধকরণের প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় কাজটি ছিল দূতাবাস কর্তৃক নাগরিকত্ব যাচাই সাপেক্ষে যার যার দেশের কর্মীদের পাসপোর্ট প্রদান। সে সময় আমাদের অনুমান অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় চার থেকে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি কর্মী অবৈধভাবে কাজ করছিল। তাদের মধ্যে দুই লাখ ৬৭ হাজার ৮০৩ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও প্রায় ছয় হাজার জন বাংলাদেশে ফিরে যায়। আড়াই লাখের বেশি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ছিল না বলে ঘোষণা দিয়েছিল। সময় স্বল্পতার কারণে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টের পরিবর্তে মালয়েশিয়া সরকারের সম্মতি সাপেক্ষে সবাইকে হাতে লেখা পাসপোর্ট সরবরাহ করা হয়। নাগরিকত্ব যাচাইয়ের সময় রোহিঙ্গাদের প্রতি সতর্ক থাকতে হয়েছিল।

সাধারণত আমাদের কর্মীরা পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর রেজিস্ট্রেশনের সময় উল্লিখিত তাদের নিয়োগকারীরা শ্রম দপ্তরের অনুমোদনপত্রসহ ‘কর্মভিসা’র জন্য ইমিগ্রেশন দপ্তরে পাসপোর্ট জমা দিয়ে ভিসা লাগিয়ে নেয়। তবে এ ক্ষেত্রে যারা রেজিস্ট্রেশনের সময় নিয়োগকারীর নাম উল্লেখ করেনি, তারা সমস্যায় পড়ে। আবার অনেক নিয়োগকারী তার অনুমোদিত কর্মীসংখ্যার চেয়ে বেশি কর্মীকে রেজিস্ট্রেশন করায় অতিরিক্তরা বিপাকে পড়ে। আবার কেউ কাজ করত (অবৈধভাবে) এক কম্পানিতে, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক নাম রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিল অন্য কম্পানির নামে, যে পরবর্তী সময়ে ভিসা প্রসেসের সময় বেঁকে বসে। ফলে ওই কর্মীর পক্ষে আর বৈধ হওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকে আবার দালালের হাতে পাসপোর্ট ও অর্থ দিয়ে শুধু সর্বস্বান্তই হয়নি, প্রতারিত হয়ে অবৈধই রয়ে যায়। এ ছাড়া যারা ওই প্রগ্রামে অংশগ্রহণ অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করেনি, তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক বৈধ হওয়ার সুযোগটি হারায়।

২০১১ সালে আমাদের দূতাবাসের পক্ষে নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই করে এত হাতে লেখা পাসপোর্ট ইস্যু করা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল, যা আমরা যথাসময়ে সরবরাহ করতে সক্ষম হই। বর্তমানে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) সেভাবে দেওয়া দূতাবাসের পক্ষে সম্ভব হবে না। জানা মতে, সব পাসপোর্ট ঢাকা থেকে প্রিন্ট করে পাঠাতে হবে। দূতাবাস শুধু ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি নিয়ে অনলাইনে সব তথ্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেবে। আমার বিশ্বাস, আমাদের ওই সব অবৈধভাবে থাকা নাগরিকের বেশির ভাগই হয়তো তাদের এমআরপি নষ্ট করে ফেলেছে। অতএব, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে দূতাবাসে এসে হাজার হাজার লোকের  পাসপোর্টের তথ্যাদি দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে ঢাকা থেকে এত পাসপোর্ট প্রিন্ট করে মালয়েশিয়ায় প্রেরণ করা কোনোক্রমেই সহজসাধ্য কাজ নয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললেই নয়, যদি তাদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় এমআরপি থেকে থাকে, তাহলে তাদের সঠিক তথ্যাদি অনলাইনে পাঠিয়ে দিলে পাসপোর্ট প্রিন্ট সহজ হবে। এমআরপি না থাকলে নাগরিকত্ব যাচাই করার পরই পাসপোর্টের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা বা অন্য দেশের নাগরিকরা যেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট না পায় আমাদের কর্তৃপক্ষকে তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের অভিবাসী কর্মীরা পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর যাতে তাদের নিয়োগকারীরা যথানিয়মে সময়সীমার মধ্যে ‘কর্মভিসা’ লাগানোর জন্য মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দেয় সে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যগতভাবে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীরা (বড় কম্পানি ছাড়া) শ্রম বা ইমিগ্রেশন দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করতে চায় না, তারা দালাল বা এজেন্টের মাধ্যমে এসব করে থাকে (আশার কথা, এবার তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা থাকবে না)। আমাদের কর্মীদের এ ব্যাপারে তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে তাদের পাসপোর্ট ভিসার জন্য ইমিগ্রেশনে জমা পড়ে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আমাদের কর্মীরা পাসপোর্ট করার সময় তাদের যার যার নিয়োগকারী থেকে একটি পত্র নিয়ে আসে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সে ওখানে কর্মরত বা তাকে বিধি-বিধান মেনে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এ কথা সত্য, এর পরও কিছু লোক ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ অবস্থানে থেকেই কাজ করে যাবে।

মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই আন্তরিক, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং দৃঢ়। ২০১১ সালে মালয়েশিয়া সরকার, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈধকরণ প্রক্রিয়াকে সফল করার জন্য নানাভাবে আমাদের দূতাবাসকে সাহায্য করেছিল। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো সেরি হিশামুদ্দিন এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুজনই বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আমাদের কর্মীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। যেকোনো সমস্যায় প্রয়োজনে তাঁদের পরামর্শ বা সাহায্য পাওয়া যাবে বলে আমার আস্থা রয়েছে। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটাই কথা, আমাদের কর্মীরা যাতে সময়মতো পাসপোর্ট হাতে পায় এবং তাদের নিয়োগকারীরা যথাযথভাবে ইমিগ্রেশনে জমা দেয়, তা নিশ্চিত ও মনিটর করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, তারা যেন কোনোভাবেই প্রতারণা ও হয়রানির শিকার না হয়। আমাদের সব অবৈধ অভিবাসী কর্মী মালয়েশিয়া সরকারের এই বদান্যতায় বৈধভাবে নিরাপত্তার সঙ্গে সে দেশে কাজ করার সুযোগ গ্রহণ করে তাদের পরিবারের তথা দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করবে, সে প্রত্যাশাই রইল।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ