দেশে ফেরাতে বিশেষ উদ্যোগ

বিদেশে পলাতক ৫০ অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ, শেয়ার ও ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অভিযোগে তাদের বিষয়ে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি তাদের পাচার করা অবৈধ অর্থের সন্ধান দিতে বেশ কয়েকটি দেশে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠানো হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ তালিকা পাঠানো হবে।

আরও জানা গেছে, ওই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য (এমপি) শহীদুল ইসলাম পাপুল, আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) যুবলীগের বহিষ্কৃত দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী, বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান, এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, শেয়ার খাতের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল, ঢাকার আদালতের একজন বিচারক। এছাড়া আছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মচারী আবজালের পাচার করা অর্থও ফিরিয়ে আনতে ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

আবজাল ছাড়া বাকিদের বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নিচ্ছে দুদক। একই সঙ্গে প্রথম তালিকায় নাম থাকা ৫০ জনের পাচার করা অর্থের সন্ধান চেয়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও হংকংয়ে এমএলএআর পাঠানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে দুদক। এছাড়া অর্থ পাচার মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত শেষ করতে দুদকের প্রসিকিউশনকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে থাকা মামলার বিচার শেষ হলে রায়ের কপিসহ আরও অন্তত ৫০ জনের সম্পদ বিদেশ থেকে ফেরত আনতে দ্বিতীয় দফায় পদক্ষেপ নেবে দুদক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ  বলেন, যতদূর মনে পড়ে ৫০ জনের বিষয়ে তথ্য চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশের সেন্ট্রাল কর্তৃপক্ষের কাছে এমএলএআর পাঠাবে। এখন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই বাংলাদেশের পক্ষে এমএলএআর পাঠানোর বিষয়ে কাজ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, পুরনো ২২টি এমএলএআর দেখবে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়।

দুদকের প্রধান কৌশলী খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে এমএলআর সংক্রান্ত আইনি ব্যাখ্যায় বলেন, এখন থেকে দুদক এ সংক্রান্ত পত্র পাঠিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য চাইবে। আর এজন্য ২০১২ সালে এমএলএআর অ্যাক্টও করা হয়েছে। যাদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে তাদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন, বিদেশে বাড়ি-গাড়ির তথ্যও দিতে বলা হবে। তবে উল্লেখযোগ্য তথ্য দিতে বলা হয় অন্যান্য দেশে কোনো কোনো বাংলাদেশির বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে। ওইসব দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ (অপরাধ গোয়েন্দা বিভাগ) সার্চিং করে তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশকে দিতে এমএলএআরে অনুরোধ করা হয়।

তিনি আরও জানান, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুদক থেকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তদন্তে পাওয়া তথ্য ও মামলার বিষয়বস্তুও পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। যাতে ওই দেশগুলো এমএলএআর দেখে বুঝতে পারে তালিকার লোকটি বাংলাদেশের আইনে অপরাধী।

পিকে হালদার, কাজী আনিস দম্পতি, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম পাপুল, বেসিক ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম, ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান, এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, লুৎফর রহমান বাদলসহ অন্তত ৫০ জনকে দেশে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হচ্ছে বলে জানান খুরশিদ আলম খান। যাদের মধ্যে একজন বিচারকও রয়েছেন। তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। পাপুল, তার স্ত্রী ও শ্যালিকার বিরুদ্ধে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। এছাড়া পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতের আদালতে চার্জ গঠন হয়েছে।

সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যের আবজাল দুদকের জালে ধরা পড়ে এখন জেলে থাকলেও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় তার বিপুল সম্পদের তথ্য তিনি নিজেই দুদকের কাছে স্বীকার করেছেন। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই ওইসব দেশের পাচার করা সম্পদ ও অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে চায় দুদক।

কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তে অন্তত একশ’ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তিনি মালয়েশিয়া ও ভারতে টাকা পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে তথ্য মিলেছে। উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান এরই মধ্যে কাজী আনিস দম্পতির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ পাচারের মামলার তদন্ত শেষ করে এনেছেন। কাজী আনিস পার্শ^বর্তী কোনো দেশে রয়েছেন বলেও জানতে পেরেছে দুদক।

দুদকের ক্যাসিনো দুর্নীতির মামলায় চার্জশিট তালিকায় লিজিং কোম্পানি ও আর্থিক খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত প্রশান্ত কুমার হালদারের নামও রয়েছে। ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতায় তার বিরুদ্ধে ৮ জানুয়ারি মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মামলা তদন্তে রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া আর্থিক খাত থেকে আত্মীয়স্বজন চক্রের মাধ্যমে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার কারিগর পিকে হালদারের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অফিসিয়াল তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। দুদক ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে।

বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম দুদকের ৬১ মামলার আসামি। বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অন্তত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটে জড়িত কাজী ফখরুল এখন কানাডায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এছাড়া ব্যাংকের কী পরিমাণ অর্থ তিনি দেশের বাইরে পাচার করেছেন তা জানতে এমএলএআর করা হয়েছে।

এবি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে দুদক ও বিএফআইইউ তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি পাচারের টাকার একটি অংশ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এক সড়কেই ১০টি বাড়ি করেন।

এর মধ্যে একটি দশতলা বাড়িও রয়েছে। এছাড়া তিনি ওই দেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগও করেন। একই ব্যাংকের মোহাম্মদ আলীও অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে যান। ঢাকা ট্রেডিংয়ের কর্ণধার টিপু সুলতান ঋণের নামে জনতা ব্যাংক থেকে ১৯০ কোটি টাকা ও বিডিবিএল ব্যাংক থেকে ১৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশের বাইরে চম্পট দেন।

তার এ অর্থ কোথায় আছে তা জানতে এমএলএআর করা হয়। এছাড়া দুদকের মামলার আসামি হিসেবে তাকেও দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে। একইভাবে শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত লুৎফর রহমান বাদলকে দেশে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নিতে চায় দুদক। এছাড়া এনন গ্রুপের কর্ণধার ইউনুস বাদল জনতা ব্যাংক থেকে ৫০০০ কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে কোন কোন দেশে পাচার করেছেন সেই তথ্য অনুসন্ধান করছে দুদক ও বিএফআইইউ।

একইসঙ্গে ইউনুস বাদল বর্তমানে কোথায় আছেন তা জানতে কাজ করছে দুদকের গোয়েন্দা টিম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধান ক্যাসিনোসামগ্রী কেনার নামে দেশ থেকে অন্তত ৬০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। তার পাচার করা টাকার বিষয়েও তথ্য চেয়েছে দুদক।

 

সূত্রঃ যুগান্তর