যমুনা ও ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন

ভবিতব্য কিভাবে খানদানি ঘরের এক শরিফ ও মেধাবী কিশোরকে একজন হতদরিদ্র মুটে মজুরে পরিণত করতে পারে, আমাদের প্রয়াত জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরিণত বয়সে একদিন তিনি এ দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের একজন অবিসংবাদিত নেতা হবেন, তা-ই নিয়তি হয়তো তাঁকে ছোটবেলা থেকেই সেভাবে গড়ে তুলেছিল। বিত্ত-বৈভবহীন এই জননেতা অত্যন্ত অসচ্ছল অবস্থায় গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যে সারাটি জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর গড়া রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলেও তিনি রয়ে গেছেন ক্ষমতার বাইরে। প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা বিত্ত-বেসাতের সীমানা থেকে অনেক দূরে। আজীবন সংগ্রামী মওলানা ভাসানী নিজে ভবিতব্য কিংবা নিয়তিতে বিশ্বাস করতেন কি না, তা তাঁর জীবদ্দশায় কখনো জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাইনি। উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের মুক্তি কিংবা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত এই অগ্নিপুরুষ কখনোই শহর কিংবা নগরভিত্তিক একজন রাজনীতিকের জীবনাচরণকে তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে স্থান দেননি। আজীবন এই সংগ্রামী মানুষটি বাস করে গেছেন হয় কারান্তরালে, নয়তো বা গ্রামের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মধ্যে, যা এখনকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভাবাই যায় না। এবং সেখানেই অর্থাৎ ভাসানীর বসবাসরত সেই নিভৃত পল্লীতেই দেশের অনেক প্রভাবশালী সরকারপ্রধান, মন্ত্রী কিংবা বিভিন্ন দলীয় নেতা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক কিংবা অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন। ছুটে গেছেন বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করার ব্যাকুলতা নিয়ে।

প্রমত্তা যমুনার তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ শহর। তারই অদূরে ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেদিনের আবদুল হামিদ খান। বিভিন্ন জীবনীকারের মতে, ১৮৮৫ সালের শেষের দিকে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এই কিংবদন্তি পুরুষের জন্ম হয়েছিল। বাবার নাম হাজি শরাফত আলী খান। সামান্য ভূসম্পত্তি ছাড়াও সিরাজগঞ্জ বাজারে তাঁর ছিল একটি মনিহারি পণ্যের দোকান। আবদুল হামিদ খানের পাঁচ বছর বয়সে তাঁর বাবা হঠাৎ মধ্য বয়সে পৌঁছার আগেই মারা যান। তখন শরাফত আলী খানের এক সম্পর্কীয় ভাই তাঁর পরিবার ও সম্পত্তির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবদুল হামিদ খানের আরো দুই ভাই ও এক বোন ছিলেন। দ্বিতীয় ভাই হামিদ তখন একটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন। হামিদের ডাকনাম ছিল চ্যাগা মিয়া। স্বভাব-চরিত্রে এই ছেলেটি ছিল অন্যদের তুলনায় বেশ ব্যতিক্রমী। বেশ মেধাবী ও চটপটে। এই চ্যাগা মিয়ার বয়স যখন ৯, তখন সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মহামারি আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে দু-এক দিনের ব্যবধানে হঠাৎ করে চ্যাগা মিয়ার মা, দুই ভাই ও বোনটি মারা যান। সেই আকস্মিক ঘটনায় সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন হয়ে ওঠে চ্যাগা মিয়া বা কিশোর হামিদের জীবন। জানা যায়, তাঁদের পরিবারের অভিভাবকত্ব গ্রহণকারী চাচার দুর্ব্যবহারের কারণে হামিদ তাঁর আশ্রয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে এর পেছনে হামিদের পৈতৃক সম্পত্তি দখলের চক্রান্ত দেখতে পায়। তখন সিরাজগঞ্জের কাছাকাছি এমন কোনো অনাথ আশ্রম বা এতিমখানা ছিল না, যেখানে এই আবদুল হামিদ খান নামের অনাথ কিশোর কিছুটা নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন। কলেরার প্রাদুর্ভাব-পরবর্তী সময়টায় সেখানে চলছিল দারুণ দুর্ভিক্ষ। শুধু সিরাজগঞ্জেই নয়, সমগ্র পূর্ব বাংলায় ১৮৯৭ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত সেই দুর্ভিক্ষ স্থায়ী হয়েছিল। সহায়-সম্বলহীন ও নিঃস্ব এই বালক (হামিদ) তখন বাধ্য হয়ে অন্নসংস্থানের তাগিদে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। বিভিন্ন লেখকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, কখনো যমুনার ঘাটে মুটে, কখনো মাঠের ধান কাটা মজুর, কখনো জেলেদের নৌকায় মাছ ধরার সহকারী, কখনো বাজারের দোকানে কাজ করা শ্রমিক হিসেবে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো তাঁকে। আশ্রয়হীন এই কিশোরের নির্দিষ্ট কোনো থাকার জায়গা ছিল না। কখনো বাজারের কোনো দোকানের বারান্দায় এবং কখনো যমুনা ঘাটে কোনো মালবাহী নৌকার পাটাতনে রাত কাটানোর চেষ্টা করতেন তিনি।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখতে গিয়ে ম. ইনামুল হক লিখেছেন, ‘ভাসানীর জীবন, বিশেষ করে বাল্যকালের স্মৃতির এক বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে প্রমত্তা যমুনা নদী। নৌকা, জেলে, মাছ, নদীর চর, মালবাহী নৌকা, বন্যা ইত্যাদির সঙ্গে বসবাস ও লড়াই করে কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। যমুনার বক্ষ যেন ছিল তাঁর মায়ের মতো, তাঁর একান্ত আপন পৃথিবী। তাই জীবনের বিভিন্ন সংকটজনক মুহূর্তে আমরা তাঁকে যমুনার বুকেই ফিরে যেতে দেখি। তাঁর জীবনের বিশেষ বিশেষ কর্মকাণ্ডগুলো যেন যমুনার প্রবাহপথ ঘিরেই পরিকল্পিত ও সংঘটিত হয়েছে।’ এই প্রমত্তা যমুনার মাঝেই জীবনের সূচনায় তিনি দেখেছিলেন বাঁধভাঙা ঢেউ, প্রলয়ংকরী বন্যা, সৃষ্টি ও মুক্তির ডাক। পেয়েছিলেন অবিরাম বয়ে যাওয়ার আশ্বাস ও সার্বভৌমত্বের স্বরূপ। নদীকে সীমানার দেয়ালে বাঁধা যায় না। তার সম্পদে সবার সমান অধিকার। সবার সমান মালিকানা। সে কারণেই নদী ও তার মাঝে জেগে ওঠা চরে আশ্রয় নেয় বাস্তুভিটাহীন বিপন্ন মানুষ। খুঁজে পায় বেঁচে থাকার প্রেরণা। সেই একই কারণে যমুনার বুকে আশ্রয় নিয়েছিলেন পিতৃমাতৃহীন, নিঃস্ব ও ছন্নছাড়া কিশোর চ্যাগা মিয়া, যাঁর ছিল না কোনো দ্বিতীয় পরিধেয় বস্ত্র কিংবা জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় আসবাব। সে অর্থে সত্যি তিনি ছিলেন নিঃস্ব-সর্বহারা। সে অবস্থায় এই যমুনার বুকেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মাথা গোঁজার আশ্রয়, ঠিকানা এবং সামনে এগিয়ে চলার আত্মপ্রত্যয়। ঘরছাড়া, ছন্নছাড়া এবং এক অর্থে সর্বহারা কিশোর হামিদ যখন বেঁচে থাকার কঠোর লড়াইয়ে দিনাতিপাত করছেন, তখন যমুনা নদী বেয়ে একজন সুফি সাধক সিরাজগঞ্জে এসে তাঁর তরি ভিড়িয়েছিলেন। ‘এই সুফী সাধক তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন’, লিখেছেন ম. ইনামুল হক। আরববিশ্ব থেকে ইসলাম প্রচারে আসা সেই সুফি সাধকের নাম সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদি।

জানা যায়, সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্তর ভারতের দেওবন্দ হয়ে প্রথমে আসাম এবং পরে পূর্ব বাংলার সিরাজগঞ্জে আসেন। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অনাথ কিশোর চ্যাগা মিয়াকে তাঁর ফাইফরমাশ খাটার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। বোগদাদি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই কিশোরের মেধা ও সততার পরিচয় পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। এতে তিনি কিশোর আবদুল হামিদ খানকে ইসলামী দর্শনে শিক্ষিত করার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। প্রাথমিক স্কুলে বাংলায় পড়াশোনা করা হামিদ বোগদাদির কাছে উর্দু ও আরবি ভাষা শিখেছেন বলে পরবর্তী জীবনে তাঁর মুখেই শোনা যায়। বোগদাদি ১৯০৪ সালে আসামে ফিরে যাওয়ার পথে কিশোর হামিদকে সঙ্গে নিয়ে যান। সেই থেকে কিশোর হামিদ জীবনে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা, আসামে বহিরাগত বাঙালি কৃষি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে লড়াই এবং বৃহত্তরভাবে উপমহাদেশের রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ক্রমে ক্রমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আসামকে তিনি নিজের মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে দেখেননি। সেই সময় সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদি ছিলেন আবদুল হামিদ খানের একমাত্র পথপ্রদর্শক। বোগদাদি তরুণ হামিদকে কোরআন, সুন্নাহ, দর্শন ও আইন বিষয়ে শিক্ষা দেন এবং ১৯০৭ সালে ইসলামী শাস্ত্রে অধিকতর জ্ঞানার্জনের জন্য উত্তর ভারতের দেওবন্দে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি দিল্লির বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহর সমর্থক মওলানা মোহাম্মদ কাসিম নানোতায়ীর গভীর সংস্পর্শে আসেন। মওলানা নানোতায়ী দেওবন্দের একটি মক্তবকে ‘দারুল উলুম’-এ (বিশ্ববিদ্যালয়) উন্নীত করেন। তিনি ছিলেন ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহি অভ্যুত্থানের নায়কদের উত্তরসূরি। সে কারণেই দেওবন্দে শিক্ষা গ্রহণকারীরা সাধারণত হতেন ব্রিটিশ শাসনবিরোধী ও স্বাধীনতাকামী। দেওবন্দে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আবদুল হামিদ খানের সক্রিয় রাজনীতি চর্চা ও স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা হয়েছে বলে জানা যায়। সে সময় তিনি দেওবন্দের মুক্তিসংগ্রামী, আলেম মওলানা মাহমুদুল হাসান ও মওলানা হোসেন আহমদ মাদানির কাছে পর্যায়ক্রমে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। শিক্ষা লাভ শেষে ১৯০৯ সালে তিনি আসামের জলেশ্বরে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কলকাতা হয়ে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে ফিরে এসেছিলেন। এবং কাগমারীতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বছর দুয়েক শিক্ষকতা করেছিলেন। সে সময় তিনি উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ জেলায় স্বদেশি এবং পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন বলে জানা যায়। তখন তিনি যমুনার দুই তীরে অর্থাৎ একদিকে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া এবং অন্যদিকে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। সে অবস্থায় বগুড়ার পাঁচবিবির জমিদার তাঁকে সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন বলে জানা যায়। যে আবদুল হামিদ খান ভাসানী জীবনে কখনো বিয়ে না করে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তিনি পাঁচবিবির জমিদার পরিবারের আলেমা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ সালের দিকে যুবক আবদুল হামিদ খান সশস্ত্র রাজনীতির পথ পরিহার করে ব্রিটিশবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। সে সময় তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে চিত্তরঞ্জন ময়মনসিংহ সফরে এলে যুবক আবদুল হামিদ খান তাঁর গভীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। লেখক ইনামুল হকের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯১৭ সালে কলকাতার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রায় একই সময়ে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আবদুল হামিদ খান সে অধিবেশন দুটিতেই দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ সর্বভারতীয় নেতাকে দেখে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সে অবস্থায় চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯১৯ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য আবার ময়মনসিংহে এলে আবদুল হামিদ খান তাঁর সরাসরি সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর একজন অত্যন্ত স্নেহভাজন শিষ্যে পরিণত হয়েছিলেন। এর কিছু সময় পর হামিদ খান কংগ্রেসে যোগদান করে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর। সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদি তখন আসামের জলেশ্বরে অবস্থান করছিলেন। হামিদ খান রাজনৈতিক বিষয়ে বোগদাদির পরামর্শ নিতে গেলে বোগদাদি তাঁকে তাঁর খিলাফত প্রদান করেন। খিলাফত লাভের পর আবদুল হামিদ খান একে একে মওলানা ও পীর হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং আসামে নিজের মুরিদ গ্রহণের কাজ শুরু করেন। আবদুল হামিদ খানের পীরালির বিষয়টি তখন যমুনার দুই পারে অর্থাৎ টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, এমনকি ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া আসামের গোয়ালপাড়াসহ কয়েকটি থানায় মওলানা আবদুল হামিদ খান মাদরাসা স্থাপন করে একটি কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশের পর মওলানা আবদুল হামিদ খানের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল খিলাফত আন্দোলন এবং ১৯২০ সালে গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক। পূর্ব বাংলার মওলানা আবদুল হামিদ খান সক্রিয়ভাবে সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেপ্তার হন। সেই থেকে তাঁর রাজনৈতিকভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছিল এবং জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তাঁকে কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের একপর্যায়ে গান্ধীর সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশের মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। সে কারণে চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেসে থেকেই ‘স্বরাজ দল’ গঠন করেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান উত্তর বাংলা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে কংগ্রেস ও স্বরাজ দলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। সে সময় কৃষকদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে আবদুল হামিদ খান জমিদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তখন জমিদারদের ষড়যন্ত্রে বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ১৯২৪ সালে আসামের ধুবড়ির নিকটবর্তী ভাসানচরে এসে বসতি গড়ে তোলেন। সেখানে ক্রমান্বয়ে তাঁর বিশাল মুরিদ বাহিনী গড়ে ওঠে। তাদের সহায়তায়ই তিনি সেখানে কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। সেই থেকে ভাসানচরের মওলানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান এবং তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভাসানী শব্দটি। আর ভাসানচরে গড়ে ওঠা বিশাল জনপদের নাম হয়ে গিয়েছিল তাঁর নামানুসারে ‘হামিদাবাস’। তা ছাড়া ১৩৩৯ সালে সিরাজগঞ্জে মওলানা ভাসানী ‘বঙ্গ আসাম প্রজা সম্মেলন’ আয়োজন করেছিলেন, যা উদ্বোধন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিন দিনব্যাপী সেই সম্মেলনের পর ভাসানীর নাম কৃষকের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বরাজ দল ও কংগ্রেস থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগে যোগদান করেন মওলানা ভাসানী। তিনি ছিলেন স্যার সৈয়দ সাদউল্লাহর পর আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কোয়ালিশন সরকারে স্যার সাদউল্লাহ যখন আসামের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, মওলানা ভাসানী তখন দক্ষিণ ধুবড়ি থেকে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব পাসের পর মওলানা ভাসানী আসামকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সেটা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলো, ভাসানী তখন আসামে কারারুদ্ধ। ভারতে অন্তর্ভুক্ত আসাম সরকার তখন ভাসানীকে সপরিবারে বিতাড়িত করেছিল। ধুবড়ি ছেড়ে ভাসানী আবার টাঙ্গাইলের যমুনাপারে চলে এসেছিলেন। তারপর আবার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অন্যায় শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন ভাসানী। একপর্যায়ে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। তারপর হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয় এক নতুন পথে ঠেলে দেয় সম্পূর্ণ পাকিস্তানের রাজনীতিকে।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন এবং গণবিরোধী আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন উত্খাতের লক্ষ্যে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে নৌপথে ১৫ এপ্রিল ভারতের আসাম সীমান্তে গিয়ে পৌঁছেন। ১৯৭১ সালের ১ জুন ভারতে আশ্রিত প্রবাসী বামপন্থী রাজনীতিকরা কলকাতায় এক সম্মেলন ডাকেন। এতে মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র প্রধান করা হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই মওলানা ভাসানী দেশে ফিরে আসেন এবং আবার টাঙ্গাইলের সন্তোষে অবস্থান নেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের কাছে ভাসানী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবিদাওয়া উত্থাপন করলেও বাস্তবে নীরবে-নিভৃতে তাঁর সঙ্গে (বঙ্গবন্ধু) সহযোগিতা করারই চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতৃতুল্য ভাসানীকে দেখতে কিংবা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য বিভিন্ন সময় সন্তোষে গিয়ে হাজির হয়েছেন। একাত্তরের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভাসানীর গোপন পরামর্শের স্থান ছিল যমুনায় চলমান নৌবিহারে কিংবা যমুনায় জেগে ওঠা কোনো নিভৃত চরে। সেখানে তাঁরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকতে পারতেন না। যমুনার বক্ষ কিংবা উন্মুক্ত চরই ছিল ভাসানীর জীবনের বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে তাঁর আশ্রয়ের প্রধান স্থান। অন্যান্য সময়েও প্রায়ই তিনি যমুনায় নৌকায় অবস্থান করতেন। সেখানেই যমুনার কালো জলে স্নান করতেন, খাওয়াদাওয়া ও ইবাদত-বন্দেগি করতেন। মওলানা ভাসানীর রাত জেগে ইবাদত ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করার অভ্যাস ছিল। সে কারণে প্রায়ই তিনি সন্তোষ থেকে উধাও হয়ে যমুনার বুকে আশ্রয় নিতেন। যমুনার মুক্ত বক্ষই ছিল ভাসানীর আশ্রয়কেন্দ্র, ঠিকানা ও স্থায়ী কার্যালয়। রাজধানী ঢাকায় তাঁর কোনো পার্টি অফিসে কখনো তিনি আসতেনও না, বসতেনও না। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে টাঙ্গাইলের এক নিভৃত গ্রাম সন্তোষ কিংবা যমুনার বুকে যেতে হতো। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের একজন প্রকৃত নেতা হয়তো এমনই হয়ে থাকেন, যাঁর নিজের বলতে কিছুই ছিল না। ভাসানীর স্মৃতি অমর হোক।

লেখক : শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (মুক্তিযোদ্ধা)। সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)

[email protected]

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ