মামলার স্তূপ, খেলাপি ঋণ আদায়ে সালিশেই জোর

 

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

অর্থঋণ আদালতে খেলাপি ঋণের মামলার জট কমছেই না। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ৬০টি ব্যাংকের অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৫৮৪টি। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আটকে আছে দুই লাখ ২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরে পুঞ্জীভূত মামলার স্থিতি কিছুটা কমেছে; কিন্তু আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমন পরিস্থিতিতে আদালতের বাইরে খেলাপি ঋণ আদায়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় এডিআর পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায়ে তাগাদা দেওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ওই ব্যাংকার্স সভায় খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এডিআর পদ্ধতি বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। একই সঙ্গে সভায় ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে পাওনা আদায়ের নোটিশেই মধ্যস্থতার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তকরণ, দ্রুত পাওনা আদায়ের সম্ভাবনা থাকলে কেস টু কেস ভিত্তিতে কিছুটা ছাড় দেওয়াসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এডিআর পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে মামলা করার প্রবণতা কমে আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বের করা ঋণ স্বাভাবিক নিয়মে আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বারবার সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার পরও এসব ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না খেলাপিরা। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এসব ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা হলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই কম। মূলত প্রয়োজনের তুলনায় অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম হওয়া ও বিচারকের অভাব এবং আইনি মতামতের জন্য ব্যাংকের আইনজীবীকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়ক জামানতের পর্যাপ্ত দলিলাদি সরবরাহ করতে না পারায় অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।

জানা যায়, গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দেশের সব ব্যাংকের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় মামলা সংক্রান্ত ঋণ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রম নিয়ে পৃথক দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে মামলার ঋণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আইন বিভাগের পরিচালক খোন্দকার সিদ্দিকুর রহমান। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৮ হাজার ৩৬৯টি। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর জড়িত অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। তারপরও গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের অর্থঋণ আদালতগুলোতে ৬০টি ব্যাংকের দায়ের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৫৮৪টি। এসব মামলায় ব্যাংকগুলোর আটকে রয়েছে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে এক বছর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে ব্যাংকগুলোর মামলার স্থিতি ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৭৫টি। এসব মামলায় ব্যাংকগুলোর আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২৩ সালে সার্বিক মামলার স্থিতি কমেছে প্রায় ৭ হাজার ১৯১টি। তবে একই সময়ে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।

সভায় এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় ও মামলাধীন ঋণ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে তাদের আইন বিভাগ শক্তিশালী করতে হবে। এ লক্ষ্যে আইন বিভাগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রধানসহ যোগ্য জনবল পদায়নের বিষয়ে অধিক সচেষ্ট হতে হবে। তার এই মতামতের বিষয়ে সহমত পোষণ করে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, মামলাধীন ঋণসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সভায় বিকল্প বিরোধ কার্যক্রম নিয়ে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি জানান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে স্বল্প ব্যয়ে মধ্যস্থতা অথবা সালিশির মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া সাধারণত ২ মাস ও সালিসি প্রক্রিয়া সাধারণত ৬ মাসের মধ্যে সমাপ্ত হয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল এক পত্রের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের আওতায় মধ্যস্থতা ও সালিশির মাধ্যমে পাওনা আদায়সহ অন্যান্য যে কোনো বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক) সহায়তা গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছিল। খেলাপি ঋণ আদায়ে এডিআর একটি কার্যকরী পদ্ধতি হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

এই বক্তব্যের সূত্র ধরে সভায় এডিআর পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগুলো হলো- খেলাপি গ্রাহকের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা বিবেচনায় মামলা দায়েরের পূর্বে পাওনা অর্থ পরিশোধের নোটিশে মধ্যস্থতার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তকরণ; মধ্যস্থতাকারী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিয়াক বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানে তালিকাভুক্ত দক্ষ ও যোগ্য মধ্যস্থতাকারীকে প্রাধান্য দেওয়া; মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সালিশির সাহায্য নেওয়া এবং সালিশি প্রক্রিয়ায় বিলম্ব এড়াতে বিয়াকসহ এরূপ অন্যান্য সালিশি সেন্টারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সম্পাদন; খেলাপি ঋণের পাওনা দ্রুত আদায়ের সম্ভাবনা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে কেস টু কেস ভিত্তিতে কিছুটা ছাড় দেওয়া; মধ্যস্থতা ও সালিশি প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই যেন সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা না হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা। এসব বিষয়ে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।