মাধ্যমিক শিক্ষায় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস দিতে হয়

মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অন্তত আট পর্যায়ে সেবাপ্রার্থীদের ঘুস দিতে হয়। এ ঘুসের হার ৫ হাজার থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে অনিয়ম আছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে ৩ বছরের পরিবর্তে ২০ বছর পর্যন্ত অবস্থা করছেন। এভাবে পদে পদে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি বিরাজ করছে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে সংস্থাটি বুধবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে।

এ সময় বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণে ২০ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। প্রায় আড়াই বছর ধরে এ গবেষণা পরিচালনা করে তারা। এ সময় বলা হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ও আইনি নানা ঘাটতিতে এ খাতে সুশাসনের ব্যাপক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রাক্তন ম্যানেজার তাসলিমা আক্তার হেনা। গবেষণা তত্ত্বাবধান করেন একই বিভাগের প্রাক্তন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া ও বর্তমান সিনিয়র ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তি এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বা বদলির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতিমালা লঙ্ঘন করে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। বর্তমানে অন্তত চারটি স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানি’ দিয়ে নথি অগ্রায়ন করাতে হয়। বিভিন্ন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএমসি/গভর্নিং বডি কর্তৃক নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে প্রার্থী নিয়োগের পাশাপাশি নিবন্ধন সনদ, কম্পিউটার ও অন্যান্য একাডেমিক সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের অভিযোগ আছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আইসিটির মাধ্যমে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প-২ এর আওতায় প্রকল্পমূল্য অপেক্ষা অতিরিক্ত মূল্যে পৃথক প্যাকেজে ক্রয় আদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সময় স্বল্পতা ইত্যাদি কারণ না থাকা সত্ত্বেও সরাসরি পদ্ধতির ক্রয়ের অভিযোগ আছে। প্রশিক্ষণ খাতেও বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে দরপত্র ছাড়াই দুই কোটি ২৫ লাখ দুই হাজার টাকা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, সার্টিফিকেট ও প্রশিক্ষণ সামগ্রী বাবদ ব্যয় করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদে, বিভিন্ন পর্যায়ে ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অবৈধ অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। খোদ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক হাজার ৫৭৭ জন নিবন্ধন সনদ, কম্পিউটার ও অন্যান্য একাডেমিক সনদ ইত্যাদি জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে।

প্রশিক্ষণ খাতে দরপত্র ছাড়াই অগ্রিম অর্থ উত্তোলন করে প্রকল্প পরিচালকের বছরে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা থাকলেও ৯৬ কোটি টাকা অগ্রিম তোলার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। আবার প্রশিক্ষণে উপস্থিত না থেকেও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্মানি নেওয়ার অভিযোগ আছে। সরেজমিন পরিদর্শনের প্রমাণ ছাড়াই প্রকল্প পরিচালককে ‘প্রোগ্রাম পরিচালক’ দেখিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মাসে প্রায় ১৭ লাখ টাকা সম্মানি গ্রহণ করার তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ কোভিড-১৯ অতিমারিতে কারিগরি দক্ষতা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিভাইস কেনার আর্থিক সক্ষমতার অভাবে বহু স্থানে অনলাইনে ক্লাসের কার্যক্রম সফল হয়নি। ধনী-গরিব ও শহর-গ্রামের মধ্যে শিক্ষা পাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়েছে এবং অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

এভাবে এই স্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের অনিয়ম ও সীমাবদ্ধতা উল্লেখের পাশাপাশি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ঘাটতিও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে ২০ দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। মাঠ পর্যায়ে সরাসরি রাজস্ব খাতের আওতাভুক্ত সমন্বিত জনবল কাঠামো তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি পূরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খসড়া নিয়োগবিধি দ্রুত চূড়ান্ত করা; বেসরকারি সব নিয়োগ বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা ও শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিতে পদক্রম বৃদ্ধি করা।

 

সূত্রঃ যুগান্তর