বকেয়া ৪০০ কোটি টাকা ব্যাংকে লাখেরও কম

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং ডটকমের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। এখন বকেয়া আছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। অথচ এখন অ্যাকাউন্টে এক লাখেরও কম টাকা জমা আছে। তাদের নেই কোনো অনুমোদন, লাইসেন্স ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট। ব্যবসা পরিচালনায় ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করেছে তারা।

আর ধামাকার বিরুদ্ধে গ্রাহকের করা মামলায় বুধবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বুধবার র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির মোট বকেয়ার মধ্যে সেলার বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৮০-১৯০ কোটি টাকা, কাস্টমার বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা এবং কাস্টমার রিফান্ড চেক বকেয়া ৩৫-৪০ কোটি টাকা। আর্থিক সংকটের কারণে গত কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং ডেপো ভাড়া বকেয়া রয়েছে। পাশাপাশি গত জুন থেকে কর্মচারীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। গত এপ্রিল থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলায় জুলাই থেকে এর সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও জানান, গত ২৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গী পশ্চিম থানায় এক ভুক্তভোগী প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ‘ধামাকা শপিং ডটকম’-এর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিওওসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলা ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে আরও বেশকিছু ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার ভোরে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। ওই সময় প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রানা ছাড়াও মোবাইল ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইল ক্যাটাগরির হেড ইমতিয়াজ হাসান সবুজ (৩১) ও ইলেকট্রনিক্স ক্যাটাগরির হেড ইব্রাহিম স্বপনকে (৩৩) গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাব জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয়াদি ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, ২০১৮ সালে ‘ধামাকা ডিজিটাল’ পরবর্তীকালে ২০২০ থেকে ‘ধামাকা শপিং ডটকম’ নামে কার্যক্রম শুরু হয়। গ্রেফতারকৃতরা ২০২০ থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত। গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নেতিবাচক ‘এগ্রেসিভ স্ট্র্যাটেজি’ নিয়ে মাঠে নামে। ধামাকার ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, মহাখালীতে তাদের প্রধান কার্যালয় এবং তেজগাঁও বটতলা মোড়ে একটি ডেলিভারি হাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০০টি ব্যবসায়িক চেইন রয়েছে। তার মধ্যে নামিদামি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

গ্রেফতারকৃতদের উদ্ধৃত করে র‌্যাব আরও জানায়, ধামাকা ছাড়াও তাদের আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে আছে-ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রোট্রেড ফুড এবং বেভারেজ লিমিটেড এবং মাইক্রোট্রেড আইসিক্স লিমিটেড। মূলত প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।

এছাড়া ‘হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান’ অর্থাৎ গ্রাহক ও সরবরাহকারীর টাকা আটকে রেখে অর্থ সরিয়ে ফেলা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর নানাবিধ অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করা হতো। যাতে দ্রুততম সময়ে ক্রেতা বৃদ্ধি সম্ভব হয়।

র‌্যাব জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা গেছে তাদের কর্মকাণ্ডে মূলত তারা ইনভেনটরি জিরো মডেল এবং হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান ফলো করত। কয়েকটি দেশি-বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কোনো ইনভেস্টমেন্ট ছিল না বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র‌্যাব আরও জানায়, ধামাকার গ্রাহক সংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক, গৃহস্থালিপণ্য ও ফার্নিচার ইত্যাদি বিভিন্ন অফারে বিক্রি করা হতো। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো হলো-সিগনেচার কার্ড ২০-৩০ শতাংশ, ধামাকা নাইটে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত, রেগুলারে ২০-৩০ শতাংশ ছাড় প্রদান করা। সিগনেচার কার্ড অফারটি গত মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়। মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করে অর্থ সরিয়ে গ্রাহকদের চেক প্রদান করা হয়। অতঃপর ধীরে ধীরে সব অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কারসাজি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জেনেই তারা বিভিন্ন প্রতারণামূলক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থেকেছেন বলে জানায় র‌্যাব। এছাড়া তারা বিভিন্ন অপকৌশল প্রণয়নে প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ, সুপারিশসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান করছিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।

৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। অথচ এখন ধামাকার অ্যাকাউন্টে মাত্র লাখখানেক টাকা। বাকি টাকা কোথায় গেল জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, ধামাকার ট্রেড লাইসেন্স নেই। সাধারণ গ্রাহকরা যে টাকা দিয়েছে তা গেছে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের অ্যাকাউন্টে। ধামাকার আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে। সেসব ব্যবসায় সেই টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। টাকা আসলে কোথায় গেল, মানি লন্ডারিং পর্যায়ে পড়েছে কিনা তা খুব শিগগির বেরিয়ে আসবে।

মূলহোতা জসিম উদ্দিন চিশতির নিজস্ব সম্পদ রয়েছে আড়াইশ কোটি টাকার ওপরে। সেখানেও ধামাকার গ্রাহকদের টাকা যেতে পারে। ধামাকার প্রতারণার মূলহোতা জসিম উদ্দিন চিশতি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি পলাতক। আমরা জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের মাধ্যমে জেনেছি, তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। তাকেসহ অন্য আসামিদের খুঁজছি। আরেক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, হাজারের ওপরে তাদের কর্মচারী রয়েছে। তারা কেউই গত জুন থেকে বেতন পাচ্ছেন না। ধামাকায় আসলে চাকরি করার সুযোগ নেই। তাদের ট্রেড লাইসেন্স নেই।

 

সূত্রঃ যুগান্তর