বেলা বিস্কুট ঠেলা গাড়ি

চট্টগ্রামের মেজবানের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। তেমনি চট্টগ্রামে ভালো শুঁটকি পাওয়া যায় বা চট্টগ্রাম এলাকার লোকজন শুঁটকি খেতে বেশ পছন্দ করেন তেমন কথাও শোনা যায়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতে কোনো না কোনো বিশেষ খাবারের ঐতিহ্য রয়েছে এবং কোনো কোনো জায়গায় এখনো স্বল্প পরিসরে হলেও সেসব ঐতিহ্য টিকে আছে। তেমনি এক ঐতিহ্যের নাম ‘চাঁটগার বেলা’।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকদের আগে সকাল বেলাটা শুরু হতো চায়ের মধ্যে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ার মধ্য দিয়ে। মাঠে খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে কোনো অতিথি গেলে আপ্যায়ন করা হতো বেলা বিস্কুট দিয়ে।

বেলা বিস্কুট যে কোনো অসাধারণ বিস্কুট তা নয়। বা হাল আমলের নানা রঙে-ঢঙে তৈরি বিস্কুটের কাছাকাছিও নেই এর শিল্পরূপ। কিন্তু এখনো টিকে আছে ঐতিহ্যটা। আগে গ্রামাঞ্চলে বেলা বিস্কুট নিয়ে স্লোগান প্রচলিত ছিল ‘বেলা বিস্কুট ঠেলা গাড়ি- এক্ক (এক) ঠেলায় দোহাজারি।’

অর্থাৎ দৈনিক ভিত্তিতে যাদের কাজে নিয়োগ দেয়া হতো তারা ঠেলাগাড়ি করে কোনো মালামাল আনা-নেওয়ার আগে বেলা বিস্কুট দিয়ে চা পান করতো আর পথে খাওয়ার জন্য বোচকায় করে নিয়ে যেত বেলা বিস্কুট। এক ঠেলায় দোহাজারি যাওয়ার মানে হচ্ছে, যাতে দ্রুত কাজ করা যায়। সেই সময় দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মালামাল বহন করা হতো দোহাজারির শঙ্খ নদীর ঘাট দিয়ে। ফলে ঠেলাওয়ালারা সেখানেই মালামাল নিয়ে হাজির হতেন।

এখন অবশ্য দোহাজারি ঘাটের সেই ঐহিত্য নেই। নির্বাচনে প্রার্থীর পক্ষে স্লোগান দেয়া হতো, ‘আধখান বেলা অর্ধেক কেলা-ঝন্টু ভাইয়ের শেষ খেলা’। এখন যেমন নির্বাচনী প্রচারের জন্য সমর্থকদের টাকা দেয়া হয়, তেমনি তখন মিছিলকারীদের দেয়া হতো বেলা বিস্কুট আর কলা।

বেলা বিস্কুট দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামকে খ্যাতি এনে দিয়েছে তার নাম গনি বেকারি। ইউরোপ, আমেরিকাও জয় করেছিল চট্টগ্রামের এই বেলা। দেশ বিভাগের আগে ভারতের কয়েকটি প্রদেশেও গনি বেকারির বিক্রয় কেন্দ্র ছিল। গনি বেকারির যাত্রা শুরু হয় ১৫০ বছরেরও আগে। শুরুতে এটির কোনো নাম ছিল না। নাম ছাড়া ৫০-৬০ বছর চলার পর ১৯১০ সালে গনি বেকারি নামে এটির সাইনবোর্ড ওঠে।

আবদুল গনি সওদাগর ছিলেন ওই সময় আধুনিক গনি বেকারির রূপকার। বেকারিটি চালাতেন আবদুল গনি সওদাগরের দাদা ও বাবা। ১৯১০ সালে গনি সওদাগর বেকারির হাল ধরে নামকরণ করাসহ পুরনো বেকারি ভেঙে আধাপাকা ভবন গড়ে তোলেন। শুরু করেন মানসম্পন্ন বেলা বিস্কুট, খাস্তা বিস্কুট, পাউরুটি, কেকসহ নানা খাদ্যদ্রব্য তৈরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য রুটি সরবরাহ করা হতো এ বেকারি থেকে। ব্রিটিশরা ময়দা সরবরাহ করত। আবদুল গনির মৃত্যুর পর তার ভাইয়ের ছেলে দানু মিয়ার সময়কাল পযর্ন্ত চট্টগ্রামে গনি বেকারির ঐতিহ্য অটুট ছিল। দানু মিয়ার মৃত্যুর পর বেকারি ব্যবসায় এ পরিবারের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা কোনোরকমে ঠিকে রয়েছে।

যে বেলা বিস্কুটের এত সুনাম তার এখনকার অবস্থা জানতে গনি বেকারির ভেতরে ঢুকি; কিন্তু ঢুকেই অবাক। কারণ আগের সেই রমরমা অবস্থা নেই। ভাঙা শ্রীহীন। বাইরে বিশাল সাইনবোর্ড গনি মিয়ার অস্তিত্ব আর জায়গার নাম গনি মিয়ার নামে হলেও তার বংশধররা সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পারেননি। এক সময় বেলা বিস্কুটের যে কতটা সুনাম ছিল তা জানা গেল প্রাবন্ধিক সিদ্দিক আহমেদের লেখায়।

তিনি লিখেছেন, ঢাকায় ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে দোকানগুলোতে বিজ্ঞাপন দেখা যেত- এখানে চট্টগ্রামের বিখ্যাত বেলা বিস্কুট পাওয়া যায়। এখন যেমন কুমিল্লার রসমলাই বা অন্যান্য বিখ্যাত খাবারের নামে সাইনবোর্ড দেখা যায়। চট্টগ্রামে তখন গনি বেকারি আর লাইট বেকারির বেলা বিস্কুট চলত বেশি। লাইট বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট কিনতেন প্রধানত খাতুনগঞ্জের সওদাগর ও কোর্ট বিল্ডিং এর চাকরিজীবীরা। ২০০, ১০০, ৫০টি বেলা বিস্কুটের প্যাকেট পাওয়া যেত। সকাল বেলা বিস্কুটের বেকারিতে টাকা বা চাহিদাপত্র দিতে হতো। পরে বিকেলে চাকরি বা ব্যবসা বন্ধ করে ফিরে যাওয়ার সময় বিস্কুট নিয়ে যেত লোকজন। আর গনি বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট কিনত মূলত শহরের বাইরের যাত্রীরা। তারা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় বেলা বিস্কুট নিয়ে যেত পরিবারের জন্য।

গনি বেকারি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে। তিনি বলেন, আবদুল গনিরাই ছিলেন চট্টগ্রামে প্রথম তন্দুরে বেলা বিস্কুট বানানোর উদ্যোক্তা। ব্রিটিশ আমল থেকে তারা বেলা বিস্কুট বানাতেন। এছাড়া তারা পাউরুটি, বাখরখানি এসবও তৈরি করতেন। তবে তাদের বিশেষত্ব ছিল বেলা বিস্কুট। পাউরুটি বা বেলা বিস্কুট কিনতে হলে তাদের দোকান থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে কুপন নিতে হতো। সে সময় বিশেষ করে স্কুলের টিফিন হিসেবে বেলা বিস্কুট শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয় ছিল। মাখন দিয়ে যে বেলা বিস্কুট খাওয়া যায় সে ঐতিহ্যটা চালু হয় এখান থেকে। এখন তার নাতিরা দোকান চালান। কিন্তু আগের সে ঐতিহ্য নেই। প্রবীণ সাংবাদিক এম নাসিরুল হক দিলেন সে তথ্য। গনি বেকারির বেলা বিস্কুট সম্পর্কে তিনি জানান, আগে গনি বেকারির কাছে গুডস হিলের সামনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা বা জেলা শহরগুলোতে যাওয়ার গাড়িগুলো প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত। লোকজন গাড়ি থেকে নেমে বেলা বিস্কুট কিনতেন।

 

সূত্রঃ যুগান্তর