বিপর্যয়ের সময় মানবতাকেই প্রাধান্য দেয় ইসলাম

ইনসানিয়্যাত তথা মানবতা সাধারণভাবে মানবজাতির অস্তিত্ব ও কর্মসহ দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।

মানব জীবনের সব চাহিদাই আসলে মানবাধিকারের জন্ম দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস কিংবা মানবাধিকার বলতে প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকারকে বোঝায়।

করোনা মহামারীতে ইন্দোনেশিয়ায় মানবতাকে তিনটি প্রধান দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। যথা- ধর্ম, জাতীয়তাবাদ ও মানবতা নিজেই।

ইসলামী পরিভাষা ‘মাকাসিদে শরীয়াহ’ বলতে শরীয়তের উদ্দেশ্যকে বোঝায় যা ইসলামের প্রতিটি আইনকে নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যের সঙ্গে জুড়ে দেয়।

মাকাসিদে শরীয়াহ তথা শরীয়তের উদ্দেশ্য পাঁচটি মূলনীতি দ্বারা গঠিত। যথা-

ক. হিফজুন নাফস তথা জীবন রক্ষা

খ. হিফজুদ দ্বীন তথা ধর্ম রক্ষা

গ. হিফজুল আক্বল তথা বিবেক রক্ষা

ঘ. হিফজুন নাসল তথা বংশ রক্ষা ঙ. হিফজুল মাল তথা সম্পদ রক্ষা

এই পাঁচটি মূলনীতির মধ্যে দ্বিমতের ভিত্তিতে দুটি মূলনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।

ইসলামপন্থীরা বলেন, এগুলোর মধ্যে হিফজুদ দ্বীন তথা ধর্ম রক্ষা করাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ, এবং যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ধর্মকে রক্ষা করতে হবে।

আর এ জন্যই, এখনো অনেক লোক মসজিদে গিয়ে জুমার সালাত আদায় করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন, যদিও এতে করে জীবনবিধ্বংসী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।

আর মানবতাবাদীরা মনে করেন, উক্ত পাঁচটি মূলনীতির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হিফজুন নাফস তথা জীবন রক্ষা করা।

তাদের মতে, জীবন রক্ষার প্রশ্নে ধর্ম রক্ষাসহ অন্যান্য সব মূলনীতিকে উপেক্ষা, পরিবর্তন এমনকি প্রয়োজনবোধে বিসর্জনও দেয়া যেতে পারে।

ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া উলামা পরিষদ ও মুহাম্মাদিয়া’র মতো বড় বড় ইসলামী দলগুলোর ধর্মপণ্ডিতরা করোনা মহামারীর মধ্যেও জামাতে সালাত আদায়ের পক্ষে ফতোয়া দিয়ে মসজিদ খুলে দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন।

তাদের যুক্তি হলো, সালাত আদায় করা হিফজুদ দ্বীন তথা ধর্ম রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কেননা হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি সালাত আদায় করলো, সে দ্বীন রক্ষা করলো। আর যে সালাত ছেড়ে দিলো, সে দ্বীনকে ধ্বংস করলো।

কিন্তু কখনো কখনো মানবতার স্বার্থে সালাত আদায়ের বাধ্যবাধকতাকে শিথিল (রুখসত) করা হয়েছে। যেমন- সফররত ব্যক্তির জন্য দুই ওয়াক্তের সালাতকে একত্রিত করে আদায় করা ও নিয়মানুসারে রাকাত সংখ্যা কমিয়ে আদায় করার সুযোগ রয়েছে। আবার অক্ষম ও অসুস্থদের জন্য তাদের সুবিধামতো সালাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সংক্রমণ এড়াতে মসজিদে জামাতবদ্ধ সালাত আদায়ের বদলে নিজ নিজ গৃহে সালাত আদায় করা উচিত। এমনকি জুমা ও ঈদের সালাতের ন্যায় আবশ্যিক জামাতবদ্ধ সালাতও ঘরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জামাতে আদায় করাই উত্তম।

জীবন রক্ষার স্বার্থে ধর্মপালনে শিথিলতার আরেকটি উদাহরণ হলো পবিত্র হজ। হজ পালন করা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। কিন্তু মানবতা রক্ষার স্বার্থে হজও স্থগিত করা যেতে পারে। যেমনটি করোনার আগেও ইতিহাসে বিভিন্ন মহামারীর কারণে একাধিকবার হজ স্থগিত করা হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ জীবন দিয়েছিলো। তখন যদিও জাতীয় স্বার্থে জীবন রক্ষার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিলো; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মানবতা রক্ষার্থে প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থকেও বিসর্জন দিতে হবে।

একটি জাতির সবকিছুর উর্ধ্বে রয়েছে মানবজীবন। কোনো জাতীয় নেতার পক্ষে মানবতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা অসম্ভব।

কোভিড-১৯ এর বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সবাইকেই নিজ নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে; হোক সেটা ধর্মীয় কিংবা জাতীয়। মহামারিকালে মানুষের জীবন রক্ষার্থে প্রয়োজনে ধর্মীয় ও জাতীয় স্বার্থকে গৌণ ভূমিকায় এক পাশে রাখতে হবে।

সূত্রঃ যুগান্তর