রমজানে দেশে দেশে বৈচিত্র্যময় উদযাপন

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

রমজান মাসে বিশ্ব জুড়ে ইসলাম ধর্মানুসারীরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পানাহারসহ কিছু কাজ স্রষ্টার নির্দেশে পরিহার করেন। ধর্মীয় আচার এক হলেও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন দেশে দেখা যায় রমজানের বৈচিত্র্যময় উদযাপন।

ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানরা রমজান মাস আসার আগেই ঘরবাড়ি, আসবাব, বাসনপত্র ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে শুরু করে। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা রমজানের শুরুতে স্নান করে নিজেদের শুদ্ধ করে নেন। এই উৎসবের নাম ‘পাদুসান’। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচারের সমন্বয়ে এই উৎসবের উৎপত্তি। ইন্দোনেশিয়ায় ঝরনার গভীর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে। ঝরনায় স্নান করা পবিত্র মাসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় সেখানে।

ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের প্রথম বাহক ও প্রচারকরা এই উৎসবের প্রচলন করেন। তারাই আঞ্চলিক পবিত্র ঝরনা নির্ধারণ করে দিতেন এবং অন্যরা সেখানে গিয়ে নিজেদের বিশুদ্ধ করে নিতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় অনেকেই সুইমিংপুল, নিকটস্থ পুকুর বা বাড়িতেই তাদের পবিত্র হওয়ার এই নির্দিষ্ট স্নানটি সেরে নেন। এর উদ্দেশ্য, রমজানে রোজা শুরুর আগেই শরীর ও মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে তোলা। তারা ‘সারাং’ পরে সম্মিলিতভাবে শোভাযাত্রা করে নিকটস্থ নদী, ঝরনা বা সমুদ্রে যান। এ সময় তাদের হাতে থাকে খাদ্যপূর্ণ ঝুড়ি। তারা নিজেদের পরিষ্কার করে গোসল সম্পন্ন করে যোগ দেন সম্মিলিত প্রার্থনায়। প্রার্থনা শেষে বয়ে আনা খাবার কলাপাতার ওপরে সাজিয়ে সবাই মিলে খাবার গ্রহণ করেন।

লেবানন : মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে রোজায় প্রতিদিন কামান দাগা হয়। এটি রোজা শেষ হওয়ার সংকেত হিসেবে বিবেচিত। প্রায় ২০০ বছর আগে মিসরে এভাবে রোজা শেষের সংকেত দেওয়ার প্রথা শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। সে সময় মিসর ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের আওতাধীন। শাসক ছিলেন খোস কাদাম। কথিত আছে, খোস কাদাম একদিন সূর্যাস্তের সময় নতুন একটি কামান পরীক্ষা করার সময় ঘটনাক্রমে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেন। সমগ্র কায়রোয় শব্দটি শোনা গিয়েছিল। তারা মনে করেছিল ইফতারের সময় হয়েছে তা জানানোর জন্য বুঝি এটি নতুন শাসকের নতুন পদ্ধতি। তারা একে স্বাগত জানায়। শুধু তাই নয়, খোস কাদামের কন্যা হাজা ফাতমা এভাবেই ইফতারের সময় ঘোষণার অনুরোধ জানান। প্রথাটি মিসরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অনেক দেশে ছড়িয়ে যায়।

আরব আমিরাত : রমজানের আগমন উপলক্ষে আরব আমিরাতের শিশুদের আগের মাস শাবানের ১৫ তারিখে উজ্জ্বল কাপড় পরে দলবেঁধে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতে দেখা যায়। শিশুদের এই উৎসব ‘হক আল লায়লা’ নামে পরিচিত। এই উৎসবের সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলোর হ্যালোইন নাইটসের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এ সময় শিশুদের সঙ্গে থাকে ঝোলা। তারা প্রতিবেশীদের বাড়িতে যায়, কড়া নাড়ে আর সুর করে বলে, ‘তোমরা আমাদের দাও, আল্লাহ তোমাদের দেবেন, মক্কায় আল্লাহ তার ঘর পরিদর্শন করাবেন।’ প্রতিটি বাড়িতেই শিশুদের জন্য বরাদ্দ থাকে মিষ্টি, বাদাম ও অন্যান্য খাবার। এটি ‘খারিতা’ নামে পরিচিত।

মরক্কো : মরক্কোতে সাহরির সময় ঘুম থেকে ডেকে দেওয়ার কাজে যে পেশাজীবী শ্রেণি নিয়োজিত থাকেন তাদের নাম ‘নফর’। তারা নিজেদের বিশ্বস্ততা ও দায়িত্ববোধের কারণে বিশেষ সম্মান লাভ করে থাকেন। গেন্ডোরা (মরক্কোর এক ধরনের ঢোলা পোশাক), চপ্পল এবং ঐতিহ্যবাহী টুপি পরে শিঙা বাজিয়ে গান গেয়ে সাহরির সময় ঘোষণা করেন নফররা। এটি শুধু মরক্কোতেই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও দেখা যায়। এটি শুরু হয়েছিল সপ্তম শতাব্দী থেকে। রমজানের শেষ রাতে নগরবাসী আনুষ্ঠানিকভাবে নফরকে হাদিয়া প্রদান করেন।

ইরাক : রমজান মাসে রাতের প্রথম প্রহরে, ইফতারের পর সমগ্র ইরাকে ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই একটি ঐতিহ্যবাহী খেলার জন্য খোলা চত্বরে একত্রিত হয়। এর নাম ‘মিহবেস’। এটি প্রধানত পুরুষদের খেলা। এই খেলায় অংশ নেন প্রায় ৪০ থেকে ২৫০ জন খেলোয়াড়ের দুটি দল। সবাই পালাক্রমে মিহবেস বা আংটি লুকায়। খেলাটি শুরু হয় দলনেতার কাছ থেকে। তার হাতে ধরা থাকে আংটিটি, হাত জড়ানো থাকে কম্বলে। তিনি অন্যদের হাতে মিহবেস বা আংটি দেওয়ার ভান করেন। অন্য সদস্যরা তার হাত কোলের ওপর শক্ত মুঠি ধরে বসে থাকে। নেতা গোপনে অন্য কোনো খেলোয়াড়ের কাছে আংটি দিয়ে গেছেন তা খুঁজে বের করতে হয় অপর দলের খেলোয়াড়দের।

যদিও খেলাটির উৎস অজানা, তবে এর সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারীদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা বাড়ে। কয়েক দশক আগে, ইরাকি সরকার এই খেলাটি আয়োজন করেছিল। এর ফলে শত শত অংশগ্রহণকারী একত্রিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

আলবেনিয়া : বহু শতাব্দী ধরে, অটোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই আলবেনিয়ার রোমা মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে রোজা রাখা শুরু করে এবং ইফতার করে থাকে। তারা গানের সঙ্গে রোজা রাখে এবং ইফতার করে। রমজান মাসে প্রতিদিন তারা ঢোল বাজিয়ে রাস্তার ওপর নেচে গেয়ে মিছিল করে। এই বিশেষ ঢোল বাড়িতে হাতে তৈরি করা হয়। এর নাম ‘লোদ্রা’। লোদ্রা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ভেড়া বা ছাগলের চামড়া। মুসলিম পরিবারগুলো তাদের ইফতার শুরু ও উদযাপন করতে বাড়ির ভেতরে এই ঐতিহ্যবাহী গান-বাজনার আয়োজন করে এবং প্রতিবেশীদের দাওয়াত দেয়।