বিকল্প মাধ্যমে লেখাপড়ায় বঞ্চিত দরিদ্র শিক্ষার্থীরা

করোনাকালে পুরোদমে শুরু হয়েছে অনলাইন ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে লেখাপড়া। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সরাসরি পদ্ধতির লেখাপড়া বন্ধ আছে। এ জন্য বিকল্প মাধ্যমে ঘরে বসে এই লেখাপড়া দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রমের পাশাপাশি কোচিং-প্রাইভেট-টিউশনও চলছে অনলাইনে। পরিস্থিতি এমনই যে, সনাতনী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দিন দিন যুক্ত হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। বেতারেও পাঠদান চালুর কাজ চলছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ইন্টারনেটের ধীরগতি, স্মার্টফোন ও টেলিভিশনের অভাব এবং আর্থিক সংকটসহ অন্য দিকগুলো অনলাইন শিক্ষায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গড়ে ৪০-৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ মাধ্যমের লেখাপড়ায় যোগ দিতে পারছে না। এ অবস্থায় অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য ক্লাস নেয়ার সরঞ্জাম (ডিভাইস) ও ইন্টারনেট সংযোগ এবং ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষাদান করে যাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী সময়েও স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখা যেতে পারে। তিনি বলেন, অনলাইন শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজের ব্যাপারে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

চলতি মহামারীকালে অনলাইন এবং দূরশিক্ষণ পদ্ধতির এই পাঠদানের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  বলেন, এই মহামারীকালে সরাসরি পদ্ধতির লেখাপড়া পরিচালনা সম্ভব নয়। কবে নাগাদ আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারব তাও নিশ্চিত নই। তাই ছেলেমেয়েদের পড়ার চর্চা রাখাটাই এখন মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এই বিবেচনায় নেপথ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলেও অনলাইন বা টেলিভিশন মাধ্যমে লেখাপড়া পরিচালনার বিকল্প নেই। আমি নিজেও প্রশিক্ষণ নিয়ে অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি। তিনি মনে করেন, প্রযুক্তির এই অগ্রগতিকালে একটা সময়ে আমাদেরকে অনলাইন পাঠদানে যেতেই হতো। করোনা হয়তো সেটা আমাদেরকে আরও কাছে এনে দিয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা চিহ্নিত হচ্ছে তা নিরসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দেশে করোনাভাইরাসের কারণে ১৭ মার্চ থেকে সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত আছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ছুটির এমন পরিস্থিতির কারণে সরকারি নির্দেশে জোরেশোরে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেশি ভূমিকা রাখছে। অনলাইনে ক্লাস চালানোর জন্য গুগল ক্লাসরুম, মেসেঞ্জার, ফেসবুক গ্রুপ, জুম, গুগল মিট, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় মূলত ওয়েবসাইট এবং নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরি করে নিয়েছে। যদিও টেলিভিশন ও অনলাইনের মাধ্যমে এই পাঠদানের সুবিধা সব শিক্ষার্থী পাচ্ছে না বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় বলা হয়, মোট শিক্ষার্থীর অন্তত অর্ধেকের বাসায় টেলিভিশন নেই। তারা টিভির পাঠদান পাচ্ছে না। আর বায়োটেড নামে আরেক সংগঠনের সমীক্ষা অনুযায়ী, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস করার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ৭৭ শতাংশই আগ্রহী নন অনলাইন ক্লাসে। যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকরা দাবি করছেন, ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী টেলিভিশন পাঠদানের অধীন চলে এসেছে। অনলাইনে শিক্ষার্থীও দিন দিন বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ ক্লাস নিচ্ছে ফেসবুকে গ্রুপে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ইউটিউব চ্যানেলে শেয়ার করছে পাঠদান। রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুল ও কলেজ ক্লাস নিচ্ছে ফেসবুক পেজে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে একটি ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’ তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষকরা ফেসবুক লাইভে ক্লাস করাচ্ছেন। একইরকম স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরি করে জুম অ্যাপে লাইভ ক্লাস নিচ্ছে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ স্থানীয় সংসদ সদস্যের মালিকানাধীন একটি বেসরকারি টিভির মাধ্যমে প্রতিদিন তিনটি ক্লাস সম্প্রচার করছে। পরে ভিডিওগুলো ফেসবুকে তুলে দেয়া হয়। এ ছাড়া ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের জুমে ক্লাস শুরু হয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা নিয়েছে অনলাইনে। এ ছাড়া স্কুলটিতে করোনা বন্ধের শুরু থেকে হোয়াটসঅ্যাপে শ্রেণিভিত্তিক আলাদা গ্রুপ খুলে নোটসহ বাড়ির কাজ দেয়া হয়। এরপরই জুনের মাঝামাঝি পরীক্ষা নেয়া হয়। এভাবে রাজধানীসহ শহরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরও বেশকিছু স্কুল, কলেজ অনলাইনে ক্লাসের পাশাপাশি পরীক্ষাও নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী সারাহ আয়েশার মা আকলিমা বেগম বলেন, কিছুদিন আগে তার বাচ্চার মেসেঞ্জার গ্রুপে ক্লাস শুরু হয়েছে। এই গ্রুপে দুটি পরীক্ষাও নেয়া হয়। শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি পরীক্ষা নেন। উত্তরপত্র স্কুল খোলার পর জমা দিতে হবে শ্রেণি-শিক্ষকের কাছে। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্র নাফিস ইসলাম জানান, কিছুদিন ধরে তাদের অনলাইনে ক্লাস চলছে। দৈনিক ৩-৪টি করে ক্লাস হচ্ছে। আগামী বছর পরীক্ষার্থী হওয়ায় কোচিং এবং প্রাইভেটও অনলাইনে চলছে বলে জানিয়েছে নাফিস।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া বলেন, সাধারণ ছুটি শুরুর পর থেকেই তার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ইউটিউব ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছেন। এই ক্লাসে ছাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি আছে। তবে নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সৈয়দা আক্তার বলেন, গত ৬ জুলাই থেকে তারা জুম ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছেন। উপস্থিতি সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। তার ধারণা, ছাত্রছাত্রীদের ৩০ শতাংশ গ্রামে চলে গেছে। তারা ক্লাসে যোগ দিচ্ছে না। এ ছাড়া যাদের স্মার্টফোন বা ল্যাটপট নেই এবং আর্থিক সমস্যায় ডেটা কিনতে পারছে না, তারা ক্লাসে যোগ দিতে পারছে না। এটা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হতে পারে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু বলেন, ছেলেমেয়েরা ঘরের মধ্যে থেকে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষা যাদের আছে, তারা নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিল। অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া সচল রাখার পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। তবে অনলাইন এবং টেলিভিশন মাধ্যমে পাঠদানের মান এবং উদ্দেশ্য নিয়েও আপত্তি আছে তাদের। অনেকেই মনে করছেন, লেখাপড়ার চেয়ে বেশিরভাগের টিউশন ফি আদায়ই এ ক্ষেত্রে মুখ্য উদ্দেশ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মে মাসের দিকে বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে একই সময়ে কিছু ইংরেজি মাধ্যম স্কুল শ্রেণি কার্যক্রম চালায়। আর সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু হলে চলতি মাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ দাউদ খান  বলেন, গত ৭ জুলাই থেকে আমরা জুম অ্যাপ ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছি। শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ৫০ শতাংশের মতো। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে আছে। গ্রামে ইন্টারনেট কানেকটিভিটির এবং গতির সমস্যা প্রকট বলে জানিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। এ ছাড়া অনেকের স্মার্টফোন নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৪০-৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের। এসব শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট ডেটা কেনার ক্ষেত্রেও সংকট আছে। যে কারণে অনলাইন ক্লাসে সব শিক্ষার্থীকে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

সুত্রঃ যুগান্তর