বাগাতিপাড়ায় অসময়ে ‘গৌরমতি’ আম

মঞ্জুরুল আলম মাসুম:
অন্য সব গাছের আম যখন শেষ, তখন এই সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছে সম্প্রতি উদ্ভাবিত‘গৌরমতি’ আমের মৌসুম। নতুন উদ্ভাবিত এই আমের বাণিজ্যিক চাষে সফল হয়েছেন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার আদর্শ ফল উৎপাদক গোলাম মওলা। ২০১২ সালে এই জাতের আম উদ্ভাবনের পরের বছরে বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগরের খামারে মাত্র আটটি চারা দিয়ে গৌরমতির চাষ শুরু করেন গোলাম মওলা। প্রথমবার চার মণ ফলন পান। সেপ্টেম্বরে আমের ‘অফ সিজন’ হওয়ায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন পাঁচশত টাকা কেজি দরে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় গোলাম মওলা তৎপর হন পরিধি বাড়াতে। বর্তমানে জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিসরে গৌরমতির বাগান করেছেন তিনি। ২৪ বিঘার গৌরমতির বাগানে দুই হাজার গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে একশ’ গাছে আম ধরেছে। বর্তমানে চলছে বিপনন কার্যক্রম। কেজি প্রতি এ আম বিক্রি করছেন পাঁচশত টাকা করে।

স্থানীয় বাজারের গন্ডি পেরিয়ে গোলাম মওলার খামারের আম পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্মারক শুভেচ্ছা হিসেবে গেছে প্রধানমন্ত্রী ও কৃষি মন্ত্রীর দপ্তরে। অসময়ের আম হওয়ার কারনে চাহিদার ব্যাপকতার কারনে বিপনন কার্যক্রমের জন্যে কোথাও যেতে হয়নি তাকে। আগ্রহীরা বাগানে এসেই কৌতুহল ভরে আমের ফলন দেখছেন আর কিনছেন আম।
নাটোরের সফল ফল চাষী কলেজ শিক্ষক গোলাম মওলার জামনগরের খামার রকমারী ফলের গাছে সমৃদ্ধ। বলা চলে, জার্মপ্লাজম সেন্টার। তবে বর্তমানে খামারের সবচে’ বড় আকর্ষণ গৌরমতি আম গাছ। এক একটি আমের গড় ওজন সাতশ’ গ্রাম।

গোলাম মওলা আমকে কীটনাশকমুক্ত এবং সম্পূর্ন অর্গানিক রাখতে শুধু ব্যাগিং নয় নেট দিয়ে আমের গাছগুলোকে ঘিরেও রেখেছেন। ফল উৎপাদকদের জন্যে এটি একটি দৃষ্টান্ত বলে কৃষিবিদরা মনে করেন।

গৌরমতির পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজনে খামারে চারা উৎপাদন করলেও আগ্রহীদের কাছে বিক্রি করছেন দুই থেকে তিনশ’ টাকা দরে।


বাগাতিপাড়া উপজেলা কৃষি অফিসার মোমরেজ আলী বলেন, দেশের আড়াই শতাধিক জাতের আমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিষ্টতা এই গৌরমতি আমের। আর মিষ্টতার মাত্রা ২৭ টিএসএস। গৌরমতির চাষে অনন্য অবদান রেখেছেন গোলাম মওলা। তাঁর এই অবদান গৌরবের।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের জাতীয় পরামর্শক এস এম কামরুজ্জামান এবং প্রকল্প পরিচালক মেহেদী মাসুদ সম্প্রতি গোলাম মওলার গৌরমতির খামার পরিদর্শন করেছেন।

গৌরমতি আমের উদ্ভাবনের ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের জাতীয় পরামর্শক এবং মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ফল বিজ্ঞানী এস এস কামরুজ্জামান সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার থেকে কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে কিছু আম পাঠানো হয়। অজ্ঞাত জাতের এই আম খেয়ে মুগ্ধ হন মন্ত্রী।

এ কথা কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানতে পারে উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। এরপর ওই আমের গাছ সনাক্ত করা হয়-চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ এলাকার শিয়ালমারা এলাকায়। জাহাঙ্গীর মাষ্টারের আশ্বিণা আম বাগান থেকে সংগৃহিত ঐ গাছে তখনো কয়েকটি আম ছিল। সংগ্রহ করা হয় আটটি আম। শুরু করা হয় প্রকল্পের পক্ষ থেকে এই গাছের চারা উৎপাদন কার্যক্রম। পরের বছর মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের পক্ষ থেকে ঐ গাছের সব আম কিনে নেয়া হয়। আর আম ধরা গাছের নীচে দেশের ৬০টি হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদদের নিয়ে বসে বৈঠক। বৈঠক শেষে এই গাছের আমের চারা তৈরীর জন্যে সবার হাতে তুলে দেয়া হলো গাছের সায়ন (কলম করার উপযোগী গাছের কচি ডগা)। এরপর থেকে সকল হর্টিকালচার সেন্টারে তৈরী হতে শুরু করে এই গাছের চারা। এখন এসব চারা ফল দিতে শুরু করেছে।

এই আমের নামকরণ সম্পর্কে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহনকারী ফল গবেষক এস এম কামরুজ্জামান সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, প্রাচীন বাংলার গৌর এলাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবস্থান হওয়ায় গৌর শব্দটি এসেছে আর মতি হচ্ছে মহামূল্যবান। এই দু’য়ের সমন্বয়ে উদ্যানতত্ত্ববিদদের ঐ বৈঠকে আমার প্রস্তাবনায় নামকরণ করা হলো গৌরমতি।