বাইরে তালা ভেতরে খোলা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কয়েল তৈরির কারখানা

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়ে অনুমোদনহীন অর্ধশতাধিক কয়েল তৈরির কারখানায় কাজ করছে কয়েক শ শিশুশ্রমিক। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কঠোর লকডাউনের মধ্যে এসব কারখানা চললেও নজরে আসছে না প্রশাসনের। এসব কারখানায় মূল ফটক তালা দিয়ে রাখা হয় সব সময়ই। নেই প্রতিষ্ঠানের নামের সাইনবোর্ড। বেশির ভাগ কারখানায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার না করেই কাজ চলছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ কয়েল করাখানায় চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। ফলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সরেজমিনে কয়েল কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানার মূল ফটক বাইর থেকে তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে কয়েল তৈরি করছে তারা।

অন্যদিকে আবাসিক এলাকায় কয়েল কারখানা থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক লাখ বাসিন্দা। স্থানীয়রা বলছেন, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সবাই। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এসব অবৈধ কয়েল তৈরির কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিছিন্ন করলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় গ্যাসলাইনের আবার সংযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা পরিচালনা করছেন মালিকরা। তাদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ এলাকাবাসীর।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি মৌচাক এলাকায় জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যান্ডের কয়েল তৈরি ও বিক্রি করে আসছেন। সিদ্ধিরগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় একাধিক কয়েল কারখানার মালিক তিনি। তার কারখানায় প্রবেশ করেই দেখা গেলো, অধিকাংশ শিশু শ্রমিকই কাজ করছে। কয়েল বানানো, কয়েল আগুনে পোড়ানো, প্যাকেটজাত করাসহ সকল কাজ শিশুরা করছে। জিজ্ঞেস করতেই কারখানাটির ভেতর থেকে এক মেয়েশিশু বলে, গেইট খোলা নিষেধ আছে। আমরা গেইট লাগিয়ে কাজ করছি। আমাদের মালিক সাপ্তাহে দুই একবার আসেন। বাকি সময় আমরা নিজেরাই কাজ করি।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, শিশু শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আমার কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদেরকে বাদ দিতে পারছি না কোনভাবেই। বাইরে থেকে গেইটে তালাবদ্ধ রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, বাংলাদেশের বেশিরভাগ কারখানাই বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে পরিচালনা করা হচ্ছে। তাই আমরাও করছি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এর দায় আপনারা নিবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েল কারখানায় কখনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে লোক মারা যায়নি।

একই অবস্থা মিজমিজি পাকা সড়ক এলাকায় একলাছ মিয়ার মালিকানাধীন কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলে-মেয়েরা কাজ করছে সেখানে। কারখানার মূল ফটকে বুলছে তালা। একটা মেয়েশিশু শ্রমিক জানায়, আমাদের বন্ধ করে এভাবেই কাজ করতে বাধ্য করছে মালিকপক্ষ। তাদের প্রশ্ন করা হলো- যদি আগুন লাগে তাহলে তোমরা কী করবা? গেটের ওই প্রান্ত থেকে তারা বললো, স্যার, তহন আমাগো মরণ ছাড়া উপায় নাই। আমাদের একটা জীবন এর কোনো দাম নাই। কাম কইরা ভাত খাই। নাইলে কাজ ছাইড়া চইলা যাইতাম।

জানা গেছে, কয়েলের ব্যবসা করেই গেল কয়েক বছরে জাহাঙ্গীর অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। স্থানীয়রা

জানান, মিজমিজি পাক্কা রোডের মাথায় কয়েলের কারখানা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা পরিচালনা করছেন এখলাছ উদ্দিন। দেশের বাড়ি গজারিয়া হলেও এই এলাকায় ব্যবসা তার দীর্ঘদিনের। শিশু শ্রমিকদের দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন তিনি। তার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ২০/২৫ জন পনের বছরের নিচে শ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন কাজ করাচ্ছেন তিনি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগে কয়েক দফা কারখানা সিলগালা করে জেল জরিমানা করলেও দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এখলাছ উদ্দিন। অবৈধ টাকার পাহাড়ে এবার নিজ এলাকা গজাারিয়ায় ইউপি নির্বাচন করবেন বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

মিজিমিজি এলাকায় পাঁচ কাঠার জমির দুটি কিনেছেন, গজারিয়া টেংগারচর এলাকায় নামে বেনামে বহু সম্পত্তির মালিক এখলাছ উদ্দিন। এখলাসের সম্পদ আর অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে এখলাছ মিয়া বলেন, আমি যা কিছু করেছি বৈধ পন্থায় করেছি। গ্যাস চুরি একটু আধটু সবাই করে তাই আমিও করি।

মিজমিজি পাগলাবাড়ি এলাকায় মহিউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি প্রায় পাঁচ বছর যাবত আবাসিক এলাকায় ব্যবসা করে আসছেন। বার বার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও মহিউদ্দিনকে কেউ দমাতে পারেনি। বাড়ির মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় জনগণ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে কীভাবে ব্যবসা করছেন জানতে চাইলে মহিউদ্দিন  জানান, আমি এখন গ্যাস চালাই না, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করি। তবে অভিযোগ রয়েছেন রাতের আঁধারে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়ে কয়েল কারখানা পরিচালনা করছেন তিনি।

আবাসিক এলাকায় কীভাবে কয়েক কারখানা পরিচালনা করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা পরিবেশের ছাড়পত্রসহ নিয়মকানুন মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করছি। শিশু শ্রমিকদের কীভাবে কাজ করাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

একই এলাকায় এটাককিং নামের একটি কয়েল কারখানার আসাদ মিয়া নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। জানা যায়, এটাককিং এর মালামাল সাব-কন্টাক্টে বানান তিনি। কয়েলের ব্যবসা করে কয়েক বছরে বহু সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি। কারখানাটিতে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের দিয়ে কয়েলের প্যাকেটজাত ও কয়েল প্রক্রিয়াজাত করছেন। কারখানাটির ম্যানেজার জানান, আসাদ মিয়া মাঝে মধ্যে কারখানায় এসে ব্যবসার খোঁজ-খবর নেন। আর সকল দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হয়।

তিনি জানান, সবাই যেভাবে করছে আমিও সেভাবেই ব্যবসা করছি। এভাবেই সিদ্ধিরগঞ্জের কান্দাপাড়া, সাহেব পাড়া, মৌচাক, মিজমিজি পশ্চিমপাড়া, বাতান পাড়া, পাগলাবাড়ি, সানারপাড় পুকুরপার, পাইনাদী শাপলাচত্তর, জালকুড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক মশার কয়েল তৈরির কারখানার মালিক অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সকল কয়েল তৈরির কারখানাগুলো বাহির থেকে তালা ঝুলিয়ে ভেতরে অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ চালানো হয়। তাদের বেশিরভাগ কারখানাতেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দেখা যায়নি। একটি দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারে কারখানার শত শত শ্রমিক। অপরিচিত কোনো ব্যক্তিকে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালানোর পর কয়েক মাস ব্যবসা বন্ধ করে কারখানাগুলো অনত্র স্থানান্তর করে আবারো আগের মতোই অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এই অবৈধ ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ মালিকেরই পরিবেশের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। এক্ষেত্রে ‘ম্যানেজ’ নামক শব্দটি তাদের প্রতিনিয়তই সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

এদিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এইসব কারখানা থাকায় লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর কারখানার মালিকরা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, তিতাস গ্যাস অভিযান পরিচালনা করে জেল জরিমানা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পরে পুনরায় গ্যাস সংযোগ দিয়ে ব্যবসা আবারো চালু হয়।

আবাসিক এলাকায় কয়েল তৈরি কারখানায় পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক  জানান, আবাসিক এলাকায় কোনভাবেই পরিবেশের ছাত্রপত্র দেওয়া হয় না। যদি কেউ পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়েছে এমন বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

করিম উদ্দিন নামে  মিজমিজি এলাকার এক বাসিন্দার জানান, বেশিরভাগ কারখানায় অধিকাংশ সময়ই বাইরে থেকে গেটে তালা লাগানো থাকলেও ভেতরে কাজ চলতে থাকে। তিনি বলেন, মাঝে ডিবি বা ম্যাজিট্রেট, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও র‍্যাব কারখানায় অভিযান চালাতে পারে। এই ভয়ে তারা লুকিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন। প্রশাসনের ভয়েই তারা বাইরের গেটে তালা দিয়ে ব্যবসা চালান বলে কারখানার মালিকরাই জানান।

নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী গোলাম ফারুক  জানান, ইতিমধ্যেই অবৈধ কয়েকটি কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কয়েকজনকে জেল জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা  জানান, যেসকল কয়েল কারখানার মালিকরা অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও বাইরে তালাবদ্ধ করে ব্যবসা পরিচলনা করছেন তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মুস্তাইম বিল্লাহ  জানান, এসকল অবৈধ কয়েল কারখানার বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মালিকদের জেল জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ ব্যবসায়ীদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

 

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ