বর্গাচাষির জীর্ণ ভাঙা কুটিরে বিদ্যার ঝলক

নিজের জমি নেই! অন্যের জমি চাষ করেন রফিকুল ইসলাম। এলাকায় ‘বর্গাচাষি রফিক’ নামে পরিচিত। সেই বর্গাচাষির দুই কন্যা আছিয়া এবং আয়েশা এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। দুই বোনই হতে চান ডাক্তার।

এদিকে কন্যাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে এই বর্গাচাষির। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার লালমা গ্রামে।

দুই বোনের সাফল্যে লালমা গ্রামে রঙিন লালিমার ছোঁয়া লেগেছে। চারদিকে রফিকের জীর্ণ ভাঙা কুটিরটি বিদ্যার ভাণ্ডার নামে খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা বর্গাচাষির গৃহটি ১২ ফুট প্রস্থ আর ৩৬ ফুট দৈর্ঘ্যরে। এই গৃহে ৪৮টি টিনের মধ্যে ৩৫টি টিনেই মরিচা ধরছে। আর ১১টি টিনে রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র; যা দিয়ে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি পড়ে।

এই গৃহের বড় মেয়ে ফারিয়া আক্তার রিংকু। জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করে। এখন পড়ছে মাস্টার্সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে।

এরপরই জ্ঞানগৃহে প্রবেশ করে আছিয়া খাতুন আর আয়েশা খাতুন। ২০১৬ সালে আছিয়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে জেএসসি পরীক্ষায় ১২তম ও আয়শা ৪৪তম স্থান অর্জন করে। দুই বোনের সাফল্যে চান্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সুনামও তখন ছড়িয়ে পড়ে। আছিয়া ময়মনসিংহ জেলার হাজারও শিক্ষার্থী পেছনে ফেলে প্রথম হয়। কিন্তু এ সাফল্যের প্রদীপ শিখায় উনুন দিতে অনেকটাই ব্যর্থ হয় তার পরিবার।

বর্গাচাষি বাবা নিজের জমি চাষের পাশাপাশি দিনমজুর হিসেবেও কাজ করে। তারপরও সবার খরচ জোগান সম্ভব হয়নি। কোনো প্রাইভেট আর কোচিংয়ে পড়ার সুযোগও পায়নি এ দুই কন্যা। চান্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে এসএসসিতে আছিয়া জিপিএ-৪.৮৯ ও আয়েশা পায় ৪.৬১ পয়েন্ট।

এরপর দুই বোন ভর্তি হন শম্ভুগঞ্জ জেকেপি কলেজে। দুই বোনই এবার এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান। তাদের এ অর্জনে আবারো আনন্দ বইছে লালমা গ্রামের আব্দুর রহমানের পুত্র রফিকুল ইসলামের গৃহে।

কন্যাদের সাফল্যে উৎফুল্ল মা ফরিদা আক্তার। তিনিও পেশায় গৃহিণী। ক্ষণিকের মধ্যেই এ সাফল্যের উৎফুল্লতা কেড়ে নিয়েছে দুশ্চিন্তা। দুই কন্যা মেডিকেলে ভর্তির জন্য উদগ্রীব। সেই লক্ষ্যে নির্ঘুম নিরলস লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের এ স্বপ্ন নিয়ে শঙ্কায় বাবা-মা।

এদিকে এ সংসারের আরেক ছেলে জুনাইদ হাসান অপু। সে পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৪.৫০ পায়। এখন চান্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

রফিকুল ইসলাম জানান, রেজাল্টের রাতে প্রচণ্ড শীত ছিল। বোরো ক্ষেতে পানি দিতে গেলাম আমার শীত লাগছে না, পানি ভর্তি ক্ষেতে পানি দিচ্ছি! বাড়ির রাস্তা দিয়ে ৩ বার এসেছি, তাও বাড়িতে আসতে পারি নাই। কেমন জানি ‘এলোমেলো’ লাগছে। সেই রাতে আর ঘুম হয়নি।

ফরিদা আক্তার বলেন, ছেলে-মেয়েদের সাফল্যের জন্য ওরা ওদের কাজটা করছে। আমরা তো ওদের প্রয়োজনীয় অর্থ, টাকা, বই-কলম দিতে পারছি না।

ওদের সাফল্য প্রসঙ্গে আনন্দ অশ্রু ঝরছে দাদা আব্দুর রহমানের (৮০)। তিনি বলেন, আমার সন্তানের সেই সামর্থ্য নেই। তারপরও ওদের এত ভালো রেজাল্ট, সব আল্লাহর ইচ্ছা।

চান্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রমজান আলী আকন্দ বলেন, প্রাইভেট কোচিং পড়ার সামর্থ্য নেই। এমন অভাবনীয় সাফল্য সত্যিই আমরা গর্বিত। শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতি, ওদের পরিশ্রমই এ সাফল্য এনে দিয়েছে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর