‘সরিষার পাশাপাশি মিলছে কোটি টাকার মধু’

বরেন্দ্র অঞ্চলে সমন্বিত চাষাবাদে অধিক লাভের স্বপ্ন কৃষকের

ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর :
দেশের খাদ্যভাণ্ডার বলে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চলে এবার রেকর্ড পরিমাণ জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এখন ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। চলতি রবি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সরিষার রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত যেমন মাঠ, তেমনি বাম্পার ফলনের হাতছানিতে কৃষকের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অনাবিল আনন্দ। যেন সরিষার হলুদ হাসিতে স্বপ্ন বুনছেন তারা।

আবার কোথাও কোথাও ক্ষেতের পাশে মৌ-বাক্স বসিয়ে সরিষা ফুল থেকে করা হচ্ছে মধু আহরণ। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌমাছির মাধ্যমে ফুলের পরাগায়ন হচ্ছে। ফলে একদিকে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে মধু পাওয়া যাচ্ছে। বাক্স পদ্ধতিতে মধু আহরণ করে সরিষা, কালিজিরা, আম ও লিচুর উৎপাদন ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বলে দাবী তাদের। আর সমন্বিত এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে কৃষকেরা এ বছর অধিক মুনাফা লাভ করবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য মতে, ২০২৩-২০২৪ রবি মৌসুমে ডিএই’র রাজশাহী অঞ্চলের আওতায় নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর জেলায় এক লাখ ৮৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য তিন লাখ ১৩ হাজার ৪৪৭ মেট্রিক টন। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন মাঠে সরিষার ক্ষেতের পাশে ১৪ হাজার ৭১৪টি মৌ-বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এসব বাক্স থেকে পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৮০ কেজি মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

প্রতি কেজি মধু ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এবার শুধুমাত্র সরিষা ফুল থেকে প্রায় ২৫ কোটি ৮৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার মধু সংগ্রহ হতে পারে বলে আশা করছেন মৌচাষি ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাজারে সরিষার দামও ভলো। ধান ও আমের রাজ্য বলে পরিচিত নওগাঁয় প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষার চাষাবাদ। বিনামূল্যে সরকারি প্রণোদনার সার ও উন্নত জাতের বীজ পেয়ে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। জেলার ১১টি উপজেলায় এবার ৬৮ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার ৬৫০ হেক্টর বেশি। গত বছর আবাদ হয়েছিল ৪৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাঁচ বছরে জেলায় সরিষার আবাদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের পর বছর স্থানীয় জাত চাষ করে ফলন কম হওয়া ও উৎপাদনে সময় বেশি লাগায় কৃষকেরা সরিষা চাষ কমিয়ে দেয়। তবে গত ৫-৬ বছর থেকে মৌসুমের শুরুতে কৃষি বিভাগ ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট’ উদ্ভাবিত অধিক ফলনশীল (উফশী) জাতের সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে। উন্নত জাতের সরিষা মাত্র ৫৫-৬০ দিনে ঘরে তোলা যায়। প্রতি হেক্টরে ফলন হয় প্রায় দেড় হাজার কেজি। সরিষা কেটে ওই জমিতে আবার বোরো ধান আবাদ করা যায়। এতে কৃষি জমির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়।

এদিকে, সম্প্রতি সরিষা চাষিদের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মাঠে মাঠে মৌ-চাষিদের আনাগোনা ব্যাপক বেড়েছে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠে রাজশাহী, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁ ও পঞ্চগড় জেলার প্রায় ২২ জন মৌ খামারি চার হাজার মৌ-বাক্স স্থাপন করেছেন। মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ করা হচ্ছে। স্থানীয় কয়েকজন মৌচাষিও এবার মধু সংগ্রহ করছেন। রাজশাহীর কেশরহাট উপজেলা থেকে নওগাঁর মান্দা উপজেলার ছোট মল্লুকপুর এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন মৌচাষি আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কসংলগ্ন একটি আমবাগানে ৫০০টি মৌ-বাক্স স্থাপন করে দুই সপ্তাহ থেকে ওই মাঠে মধু সংগ্রহের জন্য বাক্স বসিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৫০০টি বাক্স থেকে দুইবার মধু সংগ্রহ করেছেন। একটি বাক্স থেকে প্রতিবার আড়াই থেকে তিন কেজি মধু পাওয়া গেছে। গত পাঁচ বছর থেকে নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ-বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করে আসছনে তিনি।

জানতে চাইলে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক শহিদুল, ফারুক হোসেন, আজম উদ্দিন, রুহুল আলী, ফারমানসহ ২০-২২ জন কৃষক বলেন, আমন ধান কাটার পর জমি তৈরি করে সরিষা আবাদ করা হয়। ৫৫-৬০ দিনের মাথায় ফলন ঘরে আসে। এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় ২৫০০-৩০০০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ৭-৮ মণ ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কাটার পর আগে জমি পড়ে থাকত, এখন প্রতি বছরই সরিষা চাষ হয়। তারা আরও বলেন, জমিতে সরিষা চাষের সময় সার প্রয়োগ করলে বোরো ধান রোপণের জন্য আলাদাভাবে সার দিতে হয় না।

এটা স্বল্প খরচে একটি বোনাস ফসল যা প্রান্তিক কৃষকদের অনেক উপকারে আসে। নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, মৌমাছির মাধ্যমে ফুলের পরাগায়ন হয়। ফলে একদিকে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে মধু পাওয়া যাচ্ছে। মৌমাছির মাধ্যমে বাক্স পদ্ধতিতে মধু আহরণ করে সরিষা, কালিজিরা, আম ও লিচুর ১০-১৫ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রচারণার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় মৌ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল ওয়াদুদ বলেন, সরিষা চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বিনামূল্যে প্রণোদনার সার-বীজ কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। যথাযথ পরামর্শ ও পরিচর্যার বিষয়ে কৃষকদের দিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা যতক্ষণ ফসল ঘরে না তুলছেন, ততক্ষণ কৃষি বিভাগ তাদের পাশে থাকবে।