বধ্যভূমি, নাম না জানা শহিদদের স্মৃতি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা সাধারণ নাগরিক, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ধরে নিয়ে হত্যার জন্য কিছু নির্দিষ্ট স্থানকে ব্যবহার করত। যেগুলো পরবর্তীতে বধ্যভূমি হিসেবে নামকরণ করা হয়। সারা দেশেই এমন অসংখ্য বধ্যভূমি রয়েছে। এরই কয়েকটির কথা লিখেছেন গাজী মুনছুর আজিজ—

রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। ঢাকার রায়েরবাজার ইটখোলায় নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। সেজন্য এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অন্যান্য পেশাজীবী।

বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকটস যৌথভাবে এ স্মৃতিসৌধের নকশা প্রণয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহবান করে। ২২টি নকশার মধ্যে স্থপতি ফরিদউদ্দীন আহমেদ ও স্থপতি জামি-আল-শফি প্রণীত নকশাটি নির্বাচিত হয়। সমগ্র স্থানটি ৩.৫১ একর আয়তনবিশিষ্ট। এটি ১৫.২৪ মিটার বর্গাকার একটি গ্রিড দ্বারা বিভক্ত হয়েছে। মূল বেদিটি রাস্তা থেকে ২.৪৪ মিটার উঁচু। স্মৃতিসৌধের প্রধান অংশটি ১৭.৬৮ মিটার উঁচু, ০.৯১ মিটার পুরু ও ১১৫.৮২ মিটার দীর্ঘ একটি ইটের তৈরি বাঁকানো দেওয়াল। এটি রায়েরবাজারের আদি ইটখোলার প্রতীক, যেখানে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহগুলো পড়েছিল। দেওয়ালটির দুই দিক ভাঙা। এ ভগ্ন দেওয়াল ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। দেওয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে একটি ৬.১০ মিটার বর্গায়তনের জানালা আছে। এ জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়। জানালাটি দেওয়ালের বিশালতাকে কমিয়ে আনে।

বাঁকা দেওয়ালের সম্মুখভাগে একটি স্থির জলাধার আছে। জলাধারের ভেতর থেকে কালো গ্র্যানাইট পাথরের একটি স্তম্ভ উঠে এসেছে। এটি শোকের প্রতীক। স্মৃতিসৌধের প্রধান প্রবেশপথ চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এপথে প্রবেশ করলে দর্শনার্থী একটি বটগাছের মুখোমুখি হন। এ বটগাছ নিকটবর্তী শরীর-শিক্ষা কলেজ প্রাঙ্গণের আদি বটগাছের প্রতীকী রূপ। আদি বটগাছের নিচে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে পরে ইটখোলায় নিয়ে হত্যা করা হতো। চিরসবুজ বটগাছটি ছাড়া অন্য যেসব গাছ সৌধের চত্বরে লাগানো হয়েছে, সেগুলোর পাতা নির্দিষ্ট সময়ে ঝরে যায়। এ গাছগুলো ডিসেম্বরে মাসে পত্রহীন অবস্থায় থাকে।

বক্তাবলীর গণহত্যা: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার অন্যতম সাক্ষী নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলী। এ বক্তাবলীতে একাত্তরের ২৯ নভেম্বর ভোররাতে চালানো হয় নির্মম এক গণহত্যা। এ গণহত্যায় শহিদ হন এখানকার ১৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ।

ফাজিলপুর বধ্যভূমি: বুড়িগঙ্গার পাশের একটি গ্রাম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নের ফাজিলপুর-সরদারবাড়ি। এ গ্রামেই ছিল পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল ডিপু (বর্তমানে যমুনা অয়েল ডিপু)। ডিপুর পাশাদিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদী। আর এ ডিপুতেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস ধরে এ ঘাঁটিতে পাক সেনারা অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ এলাকাবাসীকে ধরে এনে হাত-পাঁ বেঁধে গুলি করে ফেলে দিতো বুড়িগঙ্গায়।

নবাব সিরাজুদ্দৌলা ক্লাব মাঠের বধ্যভূমি: ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার নবাব সিরাজুদ্দৌলা ক্লাব মাঠে পাক সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এখানে শহিদ হন প্রায় একশজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষ।

শমসেরনগর বধ্যভূমি: মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি। এখানে স্মৃতিসৌধ আছে।

পিরোজপুর: পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের নলী গ্রামের বাড়ৈবাড়িতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা: ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার আটানীবাজার এলাকায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি।

সাতক্ষীরা: সাক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুরে রয়েছে বধ্যভূমি।

বরিশাল: বরিশালের কীর্তনখোলা নদীসংলগ্ন ত্রিশ গোডাউন এলাকায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি।

খুলনা: খুলনার গল্লামারীতে আছে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি। এখানে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ রয়েছে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর