বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের অসহযোগিতায় বাড়ছে লোডশেডিং

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

সারাদেশে তাপপ্রবাহে মানুষের জীবনযাত্রা যখন ব্যাহত, তখন লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি তুলনামূলক স্বাভাবিক থাকলেও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের অসহযোগিতাকে দায়ী করছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর গ্রীষ্মে বিদ্যুতের যে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট কম উৎপাদন হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা যদি তাদের ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে রাখত, তাহলে লোডশেডিং হতো না। এখন মূলত গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা হচ্ছে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো লো-পাওয়ার ফ্যাক্টরে চলছে। তাদের সক্ষমতা প্রায় সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট। সেখান থেকে তদের অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা মাত্র ১২শ থেকে ১৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করছে। ফলে এক থেকে দেড় হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এখান থেকেই কমে গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সঙ্গে গতকাল বিদ্যুৎ বিভাগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান, সামিট গ্রুপের পরিচালক ও বিপ্পার সভাপতি মো. ফয়সাল খানসহ এর নেতৃবৃন্দ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিপ্পার নেতৃবৃন্দ তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ এবং ডলারের রেট ওঠা-নামার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, আপনারা নিয়মিতই পাওনা টাকা পাচ্ছেন। বকেয়া হলে সেটাও পেয়ে যাবেন। কিন্তু বকেয়ার অজুহাতে প্রচণ্ড গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা ঠিক হচ্ছে না। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকার কারণে গ্রামে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিপ্পাকে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৮০ পার্সেন্ট পাওয়ার ফ্যাক্টরে চালানোসহ ১ মে এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের নির্দেশ দেন তিনি।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বলেছি, এখন বিদ্যুতের চাহিদা বেশি। ফলে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হবে। দাবদাহে মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়ে স্বস্তি দেওয়াই এখন প্রধান লক্ষ্য।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্র ১৩৩টি। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫৭টি, যার উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে। ডিজেল ও ফার্সেন অয়েলভিত্তিক সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৭টি। এর মধ্যে বেসরকারি ৪৭টি। সরকারি-বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫৪১ মেগাওয়াট, এর মধ্যে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা চার হাজার ৩৬২ মেগাওয়াট। যার মধ্যে গতকালও তারা সরবরাহ করেছে মাত্র এক হাজার ৫৪৩ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বকেয়া না পাওয়ার কারণে এলসি খুলতে পারছে না এবং জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না, এ যুক্তি দেখিয়ে ফার্সেন অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় বন্ধ রেখেছে। তবে প্রচণ্ড গরমে যখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ, তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের এমন অবস্থানে ক্ষুব্ধ বিদ্যুৎ বিভাগও।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা কোথাও কোনো লোডশেডিং দিতে চাই না। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তারা যাতে মে মাসের শুরু থেকেই সক্ষমতার সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বৈঠক প্রসঙ্গে বিপ্পার প্রেসিডেন্ট ফয়সাল খান বলেন, বৈঠকে নতুন কিছু নেই। আমরা অনুরোধ করেছি, মালিকদের বকেয়া যেন যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়। যাতে ঠিক সময়ে এলসি খুলে ফার্নেস জ্বালানি তেল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পারি।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবির তথ্যমতে, গতকাল রবিবার দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট, সন্ধ্যায় ছিল ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ১২টা পর্যন্ত উৎপাদনের হিসাব পাওয়া যায়, যেখানে ওই সময় ১৫ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৩৯৮ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল এক হাজার ৮৬৪ মেগাওয়াট। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে সরকারি ওয়েসবাইটগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের প্রকৃত হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।