পাবনা টিটিসি : অধ্যক্ষ-হিসাবরক্ষক সম্পর্কে মুখরোচক আলোচনা

পাবনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি) অধ্যক্ষ মো. সাইদুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার অনৈতিক সর্ম্পক ও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে টিটিসির স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার ভুয়া ভাউচারে প্রতিষ্ঠানটির লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ শিক্ষক-কর্মচারীদের। কিন্তু অধ্যক্ষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক থাকায় শিক্ষকরাও বিব্রত। কেউ উম্মে সালমার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। বিদেশ গমনেচ্ছুক কর্মীদের বাধ্যতামূলক ৩ দিনের প্রি-ডিপারচার ট্রেনিং কোর্সের সার্টিফিকেট দিতে অবৈধভাবে টাকা আদায় করেছেন সালমা।

কিছুদিন আগে গত কয়েক দিন আগে অধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালামার একটি অন্তরঙ্গ ভিডিওচিত্র ফাঁস হয়। এছাড়া বিদেশ গমনিচ্ছুক কর্মীদের ট্রেনিং কোর্সের সার্টিফিকেট দিতে সালমার অবৈধভাবে টাকা আদায়ের অপর একটি ভিডিওচিত্রও ফাঁস হয়। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা বলছেন, অধ্যক্ষ-হিসাবরক্ষকের অনৈতিক সম্পর্কের বলি হচ্ছে পাবনা টিটিসি।

শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অধ্যক্ষ মো. সাইদুল ইসলাম ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদানের পর থেকেই হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সুযোগে অধ্যক্ষ হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম করে প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন। তার বিরুদ্ধে এর আগেও দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার একাধিক অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এই যুগল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ইতোপূর্বেও দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে অধ্যক্ষের দুইটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন করা হয়েছে। অধ্যক্ষের পূর্ব কর্মস্থলেও খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, অধ্যক্ষ সাইদুল ইসলামের স্ত্রী-পরিবার আমেরিকা প্রবাসী এবং হিসাবরক্ষকের স্বামী পাবনা না থাকায় তারা অবাধে মেলামেশা করেন। অধ্যক্ষ এবং হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার অবাধ মেলামেশায় টিটিসির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিব্রত। এই যুগলের কর্মকাণ্ডে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই কিছু বলারও সাহস পান না।

শিক্ষকদের অভিযোগ, সরকারি বিধি মোতাবেক অধ্যক্ষের কোয়ার্টারে থাকার কথা থাকলেও সে নিয়ম না মেনে তা ভাড়া দিয়ে কলেজের একাডেমিক ভবনের তৃতীয় তলায় হোটেল হাউজ কিপিংয়ের ভিআইপি রুমে থাকেন। হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অফিসের সময়ের বেশির ভাগ সময় ওই রুমে অধ্যক্ষের সাথে অবস্থান করেন। অধ্যক্ষ পাবনা টিটিসির হিসাবরক্ষকের মাধ্যমে ভুয়া ভাউচারে সরকারি ও বিভিন্ন প্রজেক্টের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন। অধ্যক্ষের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক থাকায় বর্তমানে টিটিসির হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাই টিটিসি পরিচালনা করছেন। যে কারণে টিটিসির স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙে পরেছে। হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অধ্যক্ষের রুমে অবস্থান করেন এবং টিটিসির সবাইকে তিনিই সব কাজের নির্দেশনা দেন।

একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি শিক্ষকদেরকে স্যার বলে সম্বোধন তো করেনই না উল্টো অনেক শিক্ষককে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাকে ম্যাডাম বলে ডাকতে হয়। একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর কাছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি জিম্মি হয়ে আছে। অধ্যক্ষ-হিসাবরক্ষক যুগলের ভয়ে টিটিসির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।

শিক্ষকরা জানান, গত কয়েক দিন আগে অধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালামার একটি ভিডিওচিত্র ফাঁস হয়। ভিডিওচিত্রে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাকে অধ্যক্ষের কাঁধে হাত রেখে শরীর ঘেষে বসে থেকে কথা বলতে দেখা যায়।

এদিকে সার্টিফিকেটের জন্য অবাধে ঘুষ নেওয়ার একাধিক ভিডিওচিত্র প্রকাশ পায়। ভিডিওচিত্রগুলো প্রতিবেদকের হাতে আছে।

কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে সেখানে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষক, কর্মকতা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধ্যক্ষ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহিদুল ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সব অপকর্ম করছেন। অধ্যক্ষ নিজে টাকা গ্রহণ না করে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার মাধ্যমে সমস্ত অবৈধ লেনদেন করে থাকেন।

টিটিসির দুজন শিক্ষক এই প্রতিবেদককে ভিডিওচিত্রের ঘটনার ব্যাপারে সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা পূর্ব পরিচিত। হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা ও তার পরিবার কাউকে পরোয়া করেন না। তার বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৩য় স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগসহ তার পরিবারের বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যায়।

শিক্ষকদের অভিযোগ, উম্মে সালমা সম্প্রতি ১৬ লাখ টাকা দিয়ে প্রাইভেট কার কিনেছেন। তার বাসায় একদিনে ১০ লাখ টাকার আসবাবপত্র ক্রয় করেছেন। এছাড়াও তার বাসায় সব রুমে এসি সেট করেছেন। তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিবরামপুর শাখায় তার আগের ব্যাংক লোন প্রায় পাচ লাখ টাকা এককালীন পরিশোধ করেছেন। হিসাবরক্ষকের বাড়ি টিটিসি থেকে ২৬ কিলোমিটার (ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে) দূরে হওয়ায় তিনি প্রতিদিন তার নিজস্ব প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন। তার আঙ্গুল ফলে কলাগাছ হওয়ায় টিটিসিতে অধ্যক্ষ সাইদুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার দুর্নীতির ভয়াবহতার প্রকাশ বলে আখ্যায়িত করেছেন শিক্ষকরা।

এ ব্যাপারে আরেকজন শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভাই দয়া করে আর কিছু লিখেন না। কারা সাংবাদিককে তথ্য দিয়েছে, কারা ভিডিও করেছে এ সন্দেহে প্রিন্সিপাল স্যার টিচার ও স্ট্যাফদের সাথে দুর্ব্যবহার ও হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। ভাই আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দেন।’

একজন শিক্ষক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘১০ম গ্রেডে চাকরি করেও শিক্ষকেরা যখন সংসার চালাতে হিমশিম খান, সেখানে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। হিসাবরক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতায় অনেকে ক্ষুব্ধ ও বিব্রতবোধ করলেও বদলির ভয়ে অনেকে মুখ বুঝে সহ্য করেন। কিছু বলার সাহস পান না। তিনি একজন মহিলা হওয়ায় খুব সহজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ম্যানেজ করে ফেলেন।

শিক্ষকরা আরও জানান, ‘অনৈতিক সম্পর্কের কারণে অধ্যক্ষ স্যারকে ব্ল্যাকমেইল করে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অনেক কাজ করতে বাধ্য করেন। আর এই ভিডিওচিত্র প্রকাশের পর থেকে অধ্যক্ষ স্যারও বিব্রতবোধ করছে।’

ঘুষের ভিডিওতে বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে একে একে টাকা দিয়ে সার্টিঢিকেট নিতে দেখা যায় সালমাকে। শিক্ষকরা জানান, পাবনা টিটিসিতে বিদেশ গমনিচ্ছুক কর্মীদের বাধ্যতামূলক ৩ দিনের প্রি-ডিপারচার ট্রেনিং দেওয়া হয়। এখানেও উম্মে সালমা ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ঘুষ ও সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। তিন দিনের ট্রেনিংয়ে সরকারি ফি ২০০ টাকা হলেও সার্টিফিকেট প্রতি অধ্যক্ষের স্বাক্ষরের জন্য অতিরিক্ত ২০০ টাকা করে রাখা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মী জানান, এখানে ভিসা চেকের জন্য অতিরিক্ত ১০০ টাকা এবং সার্টিফিকেট নিতে ২০০ টাকা করে দিতে হয়। আর টাকা না দিলে সার্টিফিকেট আটকে রাখা হয়। আর যারা ট্রেনিং করে না তাদের কাছে সুযোগ বুঝে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় সার্টিফিকেট বিক্রি করা হয়।’

অধ্যক্ষের বক্তব্য নেওয়ার জন্য পাবনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেলে প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে অধ্যক্ষ মো. সাইদুল ইসলাম নিজেই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অধ্যক্ষ জরুরি কাজে শহরে গিয়েছেন’।

এসময় হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে জানার জন্য উম্মে সালমাকে ফোন করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন।

পাবনার সচেতন মহল মনে করেন, দু-একজন ব্যাক্তির এমন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পাবনা টিটিসির সুনাম নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনে বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।- সূত্র: দৈনিক শিক্ষা