পলাশ বনে শিখা

শ্রাবণ মাসের আকাশ, এই হাসে এই কাঁদে। খানিকক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। গায়ের মেঠোপথ কাদায় একাকার। অবেলায় গায়ের সাপ্তাহিক হাট বসেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল ঘরমুখো মানুষের পদাঘাতে রাস্তার হয়েছে বেহাল দশা। মাটি কর্দমাক্ত হয়ে তরকারির ঝোল। হাট ফেরত লোকজন মাথায় বোঝা নিয়ে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। যদিও তাদের পায়ের গোড়ালি অবধি কাদামাটি আঁকড়ে আছে।

তাদের নির্বিঘ্নে পথচলা অবলোকন করে পলাশ বেশ মজা পাচ্ছিল। যদিও এই গাঁয়ে তার পৈতৃক আবাস। সে জন্ম থেকে বড় হয়েছে রাজধানী শহরে। এমন জীবনে সে অভ্যস্ত নহে। বাবা সরকারি অধিকর্তা। ভার্সিটির ছুটিতে নিজ বাড়িতে মেহমান। ঘরের জানালার পাশে বসে আছে, সাথে চাচাতো ভাই বোনেরা আড্ডায় মশগুল। কেউ লডু খেলছে কেউবা চোর ডাকাত। তাদের মধ্যে পাশের বাড়ির শিখাও আছে।

শিখার বাবা একজন দিনমজুর, ভিটেমাটি বিক্রি করে হলেও মেয়েকে বড় স্কুলে পড়িয়ে, বড় ঘরে বিয়ে দিবে। এটা তার জীবনের স্বপ্ন। মেয়ে তার কলেজে পড়ে এটা তার গর্ব। শিখার গায়ের রঙ ততটা ফর্সা না হলেও চেহারায় মায়ার জাদু আছে। তাছাড়া চলনে বলনে বেশ মার্জিত। পাড়াময় তার একটা কদর আলাদা। যে কোনো গৃহস্থ ঘরের ফয়ফরমাশে আলসেমি করে না।

যা বলতে চেয়েছিলাম, পলাশের শখ হলো এই কর্দমাক্ত পথে হাঁটবে। অন্যরা বারণ করেও তাকে রুখতে পারেনি। খালি পায়ে বের হয়ে গুনে গুনে পা ফেলে এগোচ্ছে আর মজা লোটছে। পেছন পা কাদা আঁকড়ে ধরলে অনেকটা হাঁটুতে ভর দিয়ে পা টেনে সামনে বাড়ে। অন্যরা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। হঠাৎ পা ফসকে কাদায় পড়ে চিৎপটাং। তা দেখে সবাই অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল।

এদিকে পলাশের পায়ের গোড়ালি মচকে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সমবয়সী ভাইবোনেরা ব্যাপারটা আমলে না নিলেও শিখা তাৎক্ষণিক দৌড়ে পলাশের হাত টেনে উঠাতে গিয়ে দেখে পলাশ ডান পায়ে ভর দিতে পারছে না। অনেকটা পাঁজাকোলা করে তাকে উঠাল। পলাশ একটা হাত শিখার কাঁধে রেখে বাম পায়ে দাঁড়াল। অন্যদের ততক্ষণে বোধ জাগল যে একটা কিছু হয়েছে। ধরাশায়ী করে তাকে চাপকলের পানিতে পরিষ্কার করে ঘরে নিল। পা অনেকটা ফুলে গেছে, ব্যথায় অস্থির। শিখা পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা দেখাচ্ছে। পলাশ ব্যথা চেপে বলে- শিখা তোমার শরীরময় কাদা, ফ্রেশ হয়ে নাও। শিখা নিজ শরীরে নজর দিয়ে দেখে সারা শরীর কর্দমাক্ত। উড়নায় কাদা দেখে লজ্জায় দৌড়ে পালাল। পলাশ বিষয়টা অবলোকন করে একটু রোমাঞ্চিত হলো।

শিখা ঘরে গিয়ে কাপড় বদলাতেই বোধোদয় হলো। এভাবে একজন পরবাসীকে পাঁজাকোলা করে ধরাটা একটা বেহায়াপনার পরিচয় দিয়েছে। মোটেও ঠিক হয়নি, সর্বাঙ্গে বেটা ছেলের ছোঁয়া লেগেছে। একাকি লজ্জা পেয়ে পড়ার টেবিলে আনমনে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। সেদিন তার কাছে পলাশ নামটাই ছিল মূল পাঠ্য।

অপরদিকে পলাশ পায়ে বেশ ব্যথা অনুভব করছিল তবু একজন উর্বশীর আলতো পরশে এক অজানা পোলক দোলায়, কল্পলোকের অতল গহীনে হারিয়ে গেল।

পরদিন সকালে বাড়ির সবাই একটা আশঙ্কায় পলাশকে নিয়ে ব্যস্ত। একজন গ্রামীণ ডাক্তার পরখ করে বলল, তেমন কিছু না; দুই-এক দিনেই ঠিক হয়ে যাবে। এত সমীহ আপ্যায়নেও তার মন ভরছে না। দুই চোখ কাকে যেন খোঁজছে। শিখা সকাল সন্ধ্যায় পলাশদের বাড়িতেই আড্ডা দেয় অথচ আজ এখনো এলো না।

শিখা ঘটনার দৃশ্যপট রোমন্থন করে পলাশের সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছিল। তবু নিত্যদিনকার অভ্যাস না এসে কি পারে?

শিখা- পলাশ ভাইয়া তোমার পায়ের ব্যথাটা কি কমেছে? পলাশ মৃদু হেসে বলে- তোমার মতো আলোক শিখা যেখানে, সেই পলাশ বনে কি আর আঁধার থাকে?

শিখা- আমায় নিয়ে মশকরা হচ্ছে, ভেবেছিলাম শহুরে মানুষ, নরম শরীর, হাড়-টার ভেঙে গেছে। এখন দেখি উনার কিছুই হয়নি।
পলাশ- ভেঙে গেলে খুশি হতে বুঝি?
শিখা- হ্যাঁ, অনেক খুশি হতাম; বলেই একটা ভেংচি কেটে চলে গেল।

শিখা- পলাশের কথায় একটু অনুরাগের গন্ধ পেল। একটু পুলকিত হয়ে নিজেকে আবার নিরাশার আবর্তে হারিয়ে ফেলল। পলাশ বড় ঘরের ছেলে। এগুলো বড়লোকের খেয়ালিপনা। অহেতুক স্বপ্ন বুনে নিজেকে পুড়িয়ে মারা বোকামি। এমন ভাবনাতে নিজেকে শক্ত করে নিল।

শিখা দুই দিন পলাশদের ঘরে আসেনি।
পলাশ শিখাদের বাড়ির উঠানে গিয়ে ডাকছে। শিখার মা পলাশকে দেখে পরম আদরে একখান জলচৌকি দিয়ে বললেন- তুমি বসো। ওর জেঠির ঘরে গেছে, আমি ডেকে নিয়ে আসছি।
শিখা তো পলাশকে দেখে হতবাক, আরে পলাশ ভাই। তুমি পায়ের ব্যথা নিয়ে। কাউকে বললেই পারতে।
পলাশ- তুমিই বলেছো আমার পায়ে কিছুই হয়নি।
কাল চলে যাব তোমায় দেখি না, তাই ভাবলাম কোনো সমস্যা হয়নি তো?
শিখা- আরে না। আমি যেতাম কিন্তু দুই দিন কয়েকটা নোট করলাম। তুমি দেখবে কেমন হয়েছে?

শিখার মা- বাবা একটু দেখে দাও না; মেয়েটা আমার কেমন পড়ালেখা পারে?
পলাশ- কই দেখি?
শিখা পলাশকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে খাতাটা মেলে দিল। পৃষ্ঠাজুড়ে কয়েকবার লেখা একটি বাক্য- “তোমার মতো আলোক শিখা যেখানে, সেই পলাশ বনে কি আঁধার থাকে”?

পলাশ অবাক বিস্ময়ে শিখার দিকে তাকাল। শিখা চোখ বুজে দাঁতে নোখ কাটছে। এই শিখা এটাই কি তোমার নোট? শিখা কিছু না বলে দ্রুত সরে পড়ল।

পলাশ অপর একটা পৃষ্ঠায় মোটা হরফে লিখলো- “জেনে রেখো, শিখার আলো যতদিন জ্বলবে, ততদিনই পলাশ বনে ফুল ফুটবে”। পলাশ নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।

প্রথম জীবনের অনুরাগ হৃদয়কে যেভাবে স্পর্শ করে, আমার মনে হয় মৃত্যুর চিরন্তন অবসাদও সেই রাগলহরী থামাতে পারে না। পলাশ বনে সত্যি আজ আলোক ঝলমল রোদেলা উৎসব।

বছর পার হয়ে গেল একে অপরের সাথে দেখা নেই। মাঝে একবার পলাশ চাচাতো ভাইকে চিঠি লিখে ছিল। সেই চিটিতে শিখার খবর নিয়েছে- এমনটাই জানিয়েছিল তার চাচাতো ভাই।

শিখা ইন্টার পাস করে আর পড়ালেখার সুযোগ পেল না। সে এক নির্মম কাহিনী- শিখার বাবা গ্রাম্য মাতুব্বরের কাছ থেকে চড়াসুদে লোন নিয়েছে। এখন সুদে আসলে হিসাব করে বসতভিটা বিক্রি করেও শোধ হয় না।
এ নিয়ে সালিশ বসল, মাতুব্বর বড়ই দয়ালু সে করল- “গরিব মানুষ সবটা যখন পরিশোধ করতে পারবা না। বাড়িটাই লিখে দাও আমার না হয় লোকসানই হলো”। এক মাস সময়ের মধ্যে ভিটে খালি করে দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে শিখারা মামার বাড়ি চলে গেল।

প্রায় দশ বছর পরের ঘটনা। পলাশ এলজিআরডির একজন কার্যনির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে একটি গ্রামীণ রাস্তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিদর্শনে গেলেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজ বাড়িতে একটু আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। গাছতলায় বসে সবার সাথে আলাপচারিতা। এরই মাঝে সাত-আট বছরের একটি বাচ্চা ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে। চেয়ারম্যান একটু ধমক দিয়ে বলল- এই ছেলে যাও। ছোট মানুষ একটু মন খারাপ করে চলে যাবে, এমন সময় পলাশ সাহেব ওকে কাছে ডাকলেন। কী নাম তোমার?
সাব্বির আহম্মদ পলাশ।

এটা তো আমার নাম, ঘরে যাও বাবা। আমরা বড়রা কথা বলছি। এরই মাঝে একটি মেয়েলী কণ্ঠ, পলাশ এদিকে এসো।
পলাশ সাহেব একটু থমকে গেলেন। কন্ঠে কেমন যেন একটা চেনাচেনা গন্ধ। একটু ঘাড় ফিরে তাকাতেই দেখে শিখা। শিখাও পলাশকে দেখে অনেকটা চমকে উঠে। আরে পলাশ ভাই যে, আপনি এখানে?

পলাশ- সরকারি কাজে আসলাম। তারপর এখানে বুঝি তোমার শুশুরালয়?
শিখা- হ্যাঁ ভাইয়া, ওটাই আমাদের ঘর। কাজ শেষে চা খেতে হবে। বলেই শিখা ঘরে চলে গেল।

পলাশ চেয়ারম্যানসহ আগতদের বিদায় দিয়ে বলল- আমি একটু বোনের বাসায় চা খাব। চেয়ারম্যান সাথে যেতে চাইলে বলল- আপনি থাকেন।
পলাশ শিখার ঘরে গিয়ে বসল। শিখা আর ছোট বাবু ছাড়া কাউকে দেখল না। স্বামী সৌদি প্রবাসী।

শিখা চা এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার ছেলে খুব চঞ্চল।
পলাশ- তোমার ছেলের নাম কি তুমি রেখেছ?
শিখা প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। ছলছল চোখে পলাশের দিকে তাকিয়ে বলল- ভাবি-বাচ্চাদের নিয়ে একদিন বেড়িয়ে যাবেন। বৃষ্টির দিনে আসবেন। তাহলে মেঠোপথে কাদায় হাঁটতে পারবেন। পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। এখানকার মাটি ততটা পিচ্ছিল না।
কথাগুলো পলাশের হৃদয়ে বর্শার ফলার মতো বিধল।
পলাশ অতিকষ্টে নিজেকে সামলিয়ে মৃদু হেসে বলল, ওই দিন শখে কাদায় হাঁটতে গিয়ে আমার পা ভাঙেনি ঠিকই কিন্তু হৃদয় ভেঙেছিল। বিধাতা আমার ভাগ্যলিপিতে লিখে দিয়েছিল। আমি কারও স্বামী বা বাবা হতে পারব না। এবার আসব, এই কার্ডটা রাখো।

শিখা ভাঙা গলায় বলল, একটু বসুন আমি আসছি। পাশের রোমে গিয়ে শিখা ফুঁপিয়ে কাঁদছে, পলাশ সেটা বুঝতে পারল। কয়েক মিনিট পর এসে একটি তেলতেলে মরীচিকা পড়া কাগজ ভাঁজে ভাঁজে অনেকাংশে ছিঁড়া। এই যে আপনার আমানত।

পলাশ- কী ওটা?
শিখা- গাড়িতে দেখবেন।

পলাশ গাড়িতে বসে সাবধানে ভাঁজ খুলে দেখল তারই লেখা- “জেনে রেখো, যতদিন শিখার আলো জ্বলবে, ততদিনই পলাশ বনে ফুল ফুটবে”।

পলাশের মনে হচ্ছিল প্রকৃতি তার রঙ পাল্টিয়ে এক অদ্ভুত কুৎসিত রূপে আবির্ভূত হয়েছে। হায়রে দারিদ্রতা তুই এতই নিষ্ঠুর! দুটি প্রাণের কলি, প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই নীরবে-নিভৃতে প্রেমের চিতায় আগুন দিয়েছিস।

 

সূত্রঃ যুগান্তর