পরিচয় বদলেছিলেন কেন অভিশ্রুতি?

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহত এক নারী সাংবাদিকের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ায় তার লাশ হস্তান্তর করা হয়নি। ওই সাংবাদিককে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে চিনতেন সহকর্মীরা। তার ফেসবুক পেজেও এই নাম উল্লেখ আছে। তবে এই নারী সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে গতকাল শুক্রবার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া থেকে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছুটে আসেন সাবরুল আলম সবুজ নামে এক ব্যক্তি। তিনি দাবি করেন, নিহত নারী সাংবাদিক তার মেয়ে এবং নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নয়, প্রকৃত নাম বৃষ্টি খাতুন।

এমন পরিস্থিতিতে ওই নারী সাংবাদিকের মরদেহ বাবা পরিচয় দেওয়া সাবরুল আলম সবুজের কাছে গতকাল হস্তান্তর করা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, আজ শনিবার (২ মার্চ) মরদেহ থেকে এবং সাবরুল আলম সবুজের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে। বাবা পরিচয় দেওয়া সবুজের নমুনার সঙ্গে ম্যাচ করলে মরদেহ তার কাছে হস্তান্তর করা হবে।

নিহত সাংবাদিকের সহকর্মীরা জানান, একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ করতেন অভিশ্রুতি ওরফে বৃষ্টি। মাসখানেক আগে অসুস্থতার কারণে চাকরি ছেড়েছিলেন। এরপর ছোট একটি অস্ত্রোপচার হয় তার শরীরে। তবে কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে অন্য একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে যোগ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছিল। চলতি মাসেই সেখানে যোগ দেওয়ার কথা। তবে তা আর হলো না, তার আগেই বেইলি রোডের আগুনে প্রাণ হারালেন এ সংবাদকর্মী।

এদিকে ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর’ মরদেহ শনাক্ত হওয়ার পর তার জন্ম-পরিচয় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বায়োডাটা অনুযায়ী তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী। বায়োডাটা অনুযায়ী পিতার নাম অভিরূপ শাস্ত্রী এবং মায়ের নাম লিখেছেন অপর্ণা শাস্ত্রী। তিনি ইডেন মহিলা কলেজে দর্শন বিভাগে অধ্যয়নরত ছিলেন। ২০১৫ সালে এসএসসি ও ২০১৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়।

‘অভিশ্রুতির’ বাবা পরিচয় দেওয়া সাবরুল আলম সবুজ এনআইডি দেখিয়ে বলেন, ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর’ আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। তার মায়ের নাম বিউটি বেগম। আর অভিশ্রুতি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ‘অভিশ্রুতি’ তার মেয়ে। তিন মেয়ের মধ্যে বড় সে। নিজের মেয়েকে নিয়ে কেন মিথ্যা বলবেন?

অভিশ্রুতি সনাতন ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব দে। তিনি বলেন, ওই তরুণীর নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। সনাতন ধর্মের অনুসারী তিনি।

বিপ্লব দে ও ‘অভিশ্রুতি’র সহকর্মীরা দাবি করেন, নিজউ পোর্টাল দ্য রিপোর্ট-এর নির্বাচন কমিশন বিটের প্রতিবেদক ছিলেন ‘অভিশ্রুতি’। এ নামেই সবাই চেনেন তাকে। অন্য একটি অফিসে যে সিভি পাঠিয়েছিলেন, সেখানেও তার নাম উল্লেখ ছিল অভিশ্রুতি শাস্ত্রী।

কী বলছেন সহপাঠীরা: ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’র এক সহপাঠী জানান, ইডেন কলেজে তিনি বৃষ্টি বণিক নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে জানত। তবে একদিন রুমমেটরা আইডি কার্ড দেখে জানে তার নাম আসলে বৃষ্টি খাতুন। তখন এ নিয়ে তার সঙ্গে কারও কারও ঝামেলা তৈরি হয়। এক রুমমেট তাকে রুম থেকে বের করে দেয়।

শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট র্কর্তৃপক্ষের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, তারা এই নারী সাংবাদিকের পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। এরপর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

অভিশ্রুতি বা বৃষ্টির জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে বাবা-মায়ের নামে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, স্থায়ী ঠিকানা সব জায়গায় একই।

২০২১ সালের ৬ জুলাই ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন হিসাবেই রয়েছে। সেখানে পিতার নাম সবুজ শেখ এবং মাতার নাম বিউটি বেগম। কলেজের প্রবেশপত্রেও তার একই রকম তথ্য আছে।

২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধন সনদে আছে নাম অভিশ্রুতি লেখা হলেও বাবার নাম লেখা হয়েছে মো. সাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।

অন্যদিকে, চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নিজের নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী লিখেছেন তিনি। তবে, বাবার নাম লেখা হয়েছে সাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম অপর্ণা শাস্ত্রী।

জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং জন্ম বৃত্তান্তে জন্ম তারিখ ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর রয়েছে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৮।

অভিশ্রুতির সাবেক কর্মস্থল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের চিফ রিপোর্টার গোলাম রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, চাকরির বায়োডাটায় তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। সবুজ শেখই অভিশ্রুতির বাবা এবং বিউটি বেগমই তার মা।

তিনি বলেন, অভিশ্রুতি হিন্দু ধর্ম চর্চা করতেন বলেই আমরা দেখেছি। নিয়মিত পূজা-অর্চনা করতে মন্দিরে যেতেন। জন্ম নিবন্ধনে তিনি নাম পরিবর্তনও করেছেন। ধর্ম পরিবর্তনের চেষ্টায় থাকতে পারেন হয়ত।’

ভারতের বেনারস থেকে অভিশ্রুতির ‘ঘটনাচক্রে’ বাংলাদেশে আসার কথা জানিয়েছেন রমনা কালী মন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা। তিনি বলেন, ‘আমাদের মন্দিরে এসে ধর্মীয় চর্চা বা পূজা অর্চনা, এই জিনিসগুলোর মাধ্যমে কিন্তু তার সাথে পরিচয়। তার পার্সোনাল বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সাথে যতটুকু শেয়ার করেছে, সেটুকু বলি- সেটা হচ্ছে তার ফ্যামিলি বেনারসে ছিল এবং তার পিতৃ পরিচয়, বেনারসে বাবা ও মা একটি মন্দিরে সেবায়েত হিসাবে ছিল, সেই জায়গা থেকে আসছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তার ফাদার-মাদার ওখানে মৃত্যবরণ করার পরে, কোনো একটা ঘটনাচক্রে, সেটি আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়নি, বা সেটি বলেনি, ঘটনাচক্রে সে বাংলাদেশে কুষ্টিয়াতে এসেছে এবং এখানে সে পড়াশোনা সে মুসলিম ফ্যামিলিতে করেছে, এটুকু আমরা জানি। এটুকু আমরা শুনেছি তার কাছ থেকে।’

অভিশ্রুতির ধর্ম পরিচয় নিয়ে আলোচনা চলছে ফেইসবুকেও। নিজেকে অভিশ্রুতির ‘কাছের বন্ধু’ পরিচয় দেওয়া মাহফুজুর রহমান নামের একজন এক পোস্টে লিখেছেন, ধর্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্নের সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্য রয়েছে তার কাছে।

মাহফুজের ভাষ্য, ‘ও যাদেরকে বাবা মা হিসাবে পরিচয় দিত, তারা মুসলিম হলেও ও নিজে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কারণ, তার মতে কুষ্টিয়ার সবুজ শেখ ও তার স্ত্রী মূলত তার পালক পিতা-মাতা, ওকে ইন্ডিয়ার কোন একটা হিন্দু পরিবার থেকে দত্তক নেয়া হয়েছিল।’

মাহফুজ লিখেছেন, ‘যদিও ওর মা দৃঢ় ভাবে দাবী করতেন ‘আমাদের পরিবারেই জন্ম নিয়েছে, ও অবশ্যই মুসলিম, ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত নামাজ পড়তো তারপর ওর বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। এই নিয়ে ওর পরিবারের সাথে ওর জটিলতা চলছিল অনেকদিন ধরেই।’