নকল পত্রিকা ছাপিয়ে আরএমপির টেন্ডার !

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:  বিজ্ঞপ্তিই ছাপা হয়নি পত্রিকায়। অথচ ‘বিজ্ঞপ্তি ছাপা পত্রিকা’ ব্যবহার করে দেয়া হয়েছে আড়াই কোটি টাকার তিন টেন্ডার। ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহী মহানগর পুলিশে (আরএমপি)। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে ও বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে এটি করেছে আরএমপির ভেতরে-বাইরের একটি চক্র।

নজিরবিহীন এ জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয়েছে তোলপাড়। পুলিশ সদর দফতর ও রাজশাহী মহানগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

সূত্র জানায়, তদন্তে প্রাথমিকভাবে এ জালিয়াতির জন্য আরএমপির বহুল আলোচিত প্রশাসনিক অফিসার আবদুল লতিফ, প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুশ ও আরএমপির হিসাবরক্ষক জুলমাত হাবিবকে দায়ী করা হয়েছে।

তবে এ ঘটনায় আরএমপিতে ওই সময়ে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করছে তদন্তকারীরা। তবে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে আপাতত আরএমপির কমিশনার এ তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন।

তবে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, তদন্তকারীদের ম্যানেজের চেষ্টা করছে সন্দেহভাজনরা। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আরএমপিতে আগেও ওষুধ কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছিল। দীর্ঘদিন একটি চক্র মুন্না নামের ঠিকাদারের সহযোগিতায় এ ধরনের দুর্নীতি করছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (সদর দফতর) ও আরএমপির মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম জানান, পুলিশ সদর দফতর থেকে এসব জালিয়াতির ঘটনা ও অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে।

এর আগে একই বিষয়ে তদন্ত করছিলেন সিকিউরিটি সেল বা পুলিশের ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড-২ বিভাগ। তদন্তের প্রাথমিক ফল ও প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরএমপির কমিশনার অধীনস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রধান সহকারী ও হিসাবরক্ষককে কৈফিয়ত তলব করেছেন।

কৈফিয়তের জবাব সন্তোষজনক না হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর পুলিশের ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের যন্ত্রপাতি ও অফিস সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ছাপা বিজ্ঞপ্তি সংবলিত একটি জাতীয় দৈনিকের কপি আরএমপির টেন্ডার ফাইলে দেখানো হয়েছে।

প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটির নম্বর-১/(২০১৬-২০১৭)। কিন্তু সারা দেশে প্রকাশিত ও প্রচারিত ওই দৈনিকটির একাধিক সংস্করণের কোনো কপিতেই আরএমপির এই বিজ্ঞপ্তিটি নেই। আসলে আরএমপির টেন্ডার জালিয়াতির জন্য অভিযুক্তরাই মুন্না নামের একজন ঠিকাদারের যোগসাজশে ওই জাতীয় পত্রিকাটির নকল কপি ছাপিয়েছেন, যা শুধু টেন্ডার ফাইলে ব্যবহার করা হয়েছে। এ টেন্ডারে ৮৬ লাখ টাকার মাল সরবরাহ করার কথা।

একইভাবে আরও দুটি টেন্ডার জালিয়াতির জন্য আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তার ফাইলে একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকের ছাপা নকল কপি পাওয়া গেছে, যাতে তাদের সরবরাহ ও জিনিসপত্র কেনাকাটার দুটি পৃথক টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাপা রয়েছে।

এসব বিজ্ঞপ্তির সূত্রেই ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে রাজশাহী মহানগর পুলিশ তাদের বার্ষিক কেনাকাটার কাজ সম্পন্ন করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই অর্থবছরের জন্য পুলিশের মনোহারি সামগ্রী সরবরাহের অপর বিজ্ঞপ্তিটি ছাপা একটি ইংরেজি দৈনিকের কপি শুধু আরএমপির টেন্ডার ফাইলে দেখানো হয়েছে। পত্রিকাটি ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বলে দেখা গেছে।

ওই পত্রিকারও ওই দিন বাজারে বিক্রীত বা ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত কোনো কপিতে এ বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়নি। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছে, এ রকম কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাপার কোনো চিঠিও তারা আরএমপি থেকে পায়নি। ফলে তারা ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি।

এজন্য কোনো বিলও দাখিল করেনি। এটি ৪৬ লাখ টাকার টেন্ডার।

একইভাবে পুলিশের ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালামাল সরবরাহ, মোটরযান যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও মেরামত, ফোর্সের পোশাক সেলাই এবং এসআই ও তার নিুপদস্থ সদস্যদের রিবন সরবরাহের তৃতীয় দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি ছাপা আরেকটি জাতীয় দৈনিকের কপি আরএমপির টেন্ডার ফাইলে দেখানো হয়েছে।

এটি ২০১৬ সালের ৪ মের কপি। এ পত্রিকারও ওই দিন বাজারে বিক্রীত বা ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত কোনো কপিতে এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। এটি ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার টেন্ডার। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছে, এ রকম কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাপার কোনো অর্ডার কপি আরএমপি থেকে তারা পাননি এবং বিলও দাখিল করেননি।

তবে দুটি পত্রিকার কর্তৃপক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাকে নিশ্চিত করেছেন যে, আরএমপির এসব বিজ্ঞপ্তি বা বিজ্ঞাপনের জন্য কোনো বিল তারা দাখিল করেননি। তবে অন্যান্য বিজ্ঞাপনের বিলের সঙ্গে আরএমপির হিসাব বিভাগ থেকে একই চেকে অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয়েছে, যা এ বিলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন টেন্ডার জালিয়াতি ও কারসাজি করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন।

জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান উত্তরপাড়ায় লতিফের একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। অন্যদিকে এ বছর জানুয়ারিতে লতিফ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের জমি কিনেছে নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় একজন ডাক্তারের কাছ থেকে।

এদিকে অভিযোগ সম্পর্কে আরএমপির প্রশাসনিক অফিসার আবদুল লতিফ, প্রধান সহকারী আবদুল কুদ্দুশ ও হিসাবরক্ষক জুলমাত হাবিবের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে যোগাযোগ করা হলে তারা তদন্তাধীন এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।

 

যুগান্তর অনলা্ইন