ধর্ম নিয়ে সংশয়ে ২৬ দিন মর্গে পড়ে থাকার পর গতি হলো কিশোরী লাকিং মে চাকমার মরদেহের

বাংলাদেশের কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে আইনি জটিলতায় ২৬দিন পড়ে থাকার পর অবশেষে কিশোরী একটি মেয়ের মরদেহের গতি হয়েছে।

সোমবার লাকিং মে চাকমার (১৫) মৃতদেহ বুঝে নিয়েছে মেয়েটির বাবা।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, মেয়েটির ধর্ম পরিচয় তদন্ত করে মেয়েটির পিতা লালা অং চাকমার কাছে তার মৃতদেহ বুঝিয়ে দেয় র‍্যাবের কর্মকর্তারা।

সেই সময় হাসপাতালের মর্গের বিল ২৪ হাজার টাকা বাকি ছিল, যা পরিশোধ করতে পারছিলেন না কিশোরী মেয়েটির দরিদ্র বাবা। হাসপাতালের সেই বিলের অর্থও পরিশোধ করে দিয়েছে র‍্যাব।

র‍্যাব-১৫ অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহম্মেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ” আমরা তদন্তে দেখতে পেয়েছি, মেয়েটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়ে হিসাবে তার বিয়ে বা ধর্ম পরিবর্তন কোনটাই বৈধ হয় না। সেই হিসাবে তার আইনগত অভিভাবক তার পিতা। তাই আমরা তার কাছেই মেয়েটির মৃতদেহ বুঝিয়ে দিয়েছি।”

”আদালত আমাদের আদেশ দিয়েছিল যে, মেয়েটির ধর্ম পরিচয় তদন্ত করে আমরা যেন বৈধ অভিভাবকের কাছে বুঝিয়ে দেই। সেই অনুযায়ী আমরা তার পিতার কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি,” তিনি বলছেন।

কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, কিশোরী মেয়েটির পরিবার তার মরদেহ রামুর একটি বৌদ্ধ মঠে নিয়ে গেছে। সেখানেই বৌদ্ধ রীতি অনুযায়ী তার পরবর্তী সৎকার হবে।

র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়েটির ধর্মান্তরকরণের ঘটনা তদন্তের পাশাপাশি অপহরণের ঘটনাও নিবিড় তদন্ত করা হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি এই বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হবে।

মেয়েটির বাবা-মা জাতিগত ভাবে চাকমা এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও মেয়েটির স্বামীর পরিবার দাবি করছে বিয়ের সময় মেয়েটি ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হয়েছিল। এরপর দুই পক্ষই মেয়েটির লাশের মালিকানা দাবি করে আদালতে আবেদন করে।

সেই পটভূমিতে তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের ‘ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত’ হয়ে সেই মোতাবেক র‍্যাবকে মরদেহ সৎকার করার নির্দেশ দিয়েছে কক্সবাজারের একটি আদালত।

এরপর কক্সবাজারের একটি আদালত নিহত কিশোরীর ধর্মান্তরকরণ এবং অপহরণের ঘটনা তদন্ত করতে দায়িত্ব দেয় র‌্যাবকে। আদালতের নির্দেশে র‌্যাব-১৫ রোববার আদালতে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। র‌্যাবের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালত রোববার লাকিং মে চাকমার মরদেহ শেষ পর্যন্ত তার পিতার জিম্মায় দেওয়ার নির্দেশ দেন।

গত ১০ই ডিসেম্বর লাকিং মে চাকমা নামের ঐ কিশোরীর মৃত্যু হওয়ার পর থেকে লাশের মালিকানা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব শুরু হলেও ঘটনার সূত্রপাত গত বছরের জানুয়ারি থেকে।

অপহরণের অভিযোগ ও পিবিআইয়ের তদন্ত

টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের লালা অং চাকমার মেয়ে লাকিং মে চাকমা স্থানীয় একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।

গত বছরের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ সন্ধ্যায় তাকে কয়েকজন অপহরণ করে বলে সেসময় অভিযোগ তোলেন মেয়েটির বাবা লালা অং চাকমা। টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করার চেষ্টা করলেও সেসময় পুলিশের কাছ থেকে আশানুরূপ সহায়তা না পেয়ে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তিনি মামলা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনজন আসামীর নাম উল্লেখ করে এবং আরও কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামী করে লালা অং চাকমা বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

ট্রাইব্যুনালের বিচারক ঐ অপহরণের ঘটনার তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, পিবিআই’এর কাছে হস্তান্তর করেন।

পিবিআই অগাস্ট মাসে তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় যে সেসময় মেয়েটি ”নিজে থেকেই অজ্ঞাত স্থানে চলে যায়” এবং যাদের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের ”অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।”

পিবিআইয়ের ঐ তদন্ত প্রতিবেদনের সাথে অন্তত তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য সংযুক্ত করা ছিল। যারা জবানবন্দী দিয়েছেন তারা বলেন, ৫ই জানুয়ারি লাকিং মে চাকমাকে তার ঘর থেকে কয়েকজন জোরপূর্বক ধরে নিয়ে সিএনজিতে করে পালিয়ে যাচ্ছে বলে তারা দেখতে পেয়েছেন।

অগাস্ট মাসে এই প্রতিবেদন যখন দেয়া হয়, তখনও লাকিং মে’র বাবা লালা অং তার মেয়ের কোনো খোঁজখবর জানতেন না।

লালা অং প্রথমবার তার মেয়ের খোঁজ পান নিখোঁজ হওয়ার ১১ মাসেরও বেশি সময়ের পর। ১০ই ডিসেম্বর তিনি একটি ফোন পান কক্সবাজার সদর থানার উপ পরিদর্শক আবদুল হালিমের কাছ থেকে। আবদুল হালিমের কাছ থেকে লালা অং জানতে পারেন যে তার মেয়ে মারা গেছে।

পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় যে মেয়ের মরদেহ তিনি নিতে পারবেন না। সেসময় তিনি জানতে পারেন যে তার মেয়ে ধর্মান্তর করে বিয়ে করেছে এবং তার স্বামীর পরিবার লাশ নিজেদের হেফাজতে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছে।

লালা অং বলেন, “তারা আমার ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে শুরুতে অপহরণ করেছে, তাকে ধর্মান্তরিত করেছে, এখন হত্যা করেছে। এখন তার লাশটা পর্যন্ত আমাকে নিতে দিচ্ছে না।”

এই ঘটনার পর ১৫ই ডিসেম্বর লালা অং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি আবেদন করেন এবং অভিযোগ তোলেন যে তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।

তার অভিযোগের ভিত্তিতে আদালত পুনরায় ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেন র‍্যাবের কাছে। এরপর র‍্যাব এই ঘটনার তদন্ত করতে শুরু করে।

স্বামীর পরিবারের বক্তব্য কী?

লালা অংয়ের ভাষ্য অনুযায়ী যদি তার মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে, তাহলে তার বিয়ে করা বা ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ার আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভুক্তভোগী লাকিং মে চাকমার স্বামীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে লাশের মালিকানা দাবি করে আদালতে আবেদন করার বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়।

তবে জানুয়ারি মাসে ভুক্তভোগীর বাবা মামলায় যে তিনজনের নাম উল্লেখ করেছিলেন, মেয়েটির স্বামী তাদের মধ্যে কেউ নন।

ভুক্তভোগীর স্বামীর বড় ভাই জানান তার ছোটভাইয়ের সাথে লাকিং মে’র বিয়ে হয়েছে, এই খবর তিনি বিয়ের পরে জানতে পারেন।

তিনি জানান, “এ বছরের শুরুর দিকে কুমিল্লায় তাদের বিয়ে হয়। সেসময় মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে বলেও আমরা জানতে পারি।”

তবে তার ছোট ভাইয়ের সাথে লাকিং মে’র বিয়ে হওয়ার কথা বললেও কীভাবে এবং কবে তাদের পরিচয়, বা কীভাবে তাদের বিয়ে হয়েছে এসব সম্পর্কে বিস্তারিত তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি বা পরিষ্কার করে কিছু বলেননি।

১০ই ডিসেম্বর সামান্য পারিবারিক কলহের জের ধরে লাকিং মে বিষ পান করে বলে জানান তিনি। পরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে লাকিং মে’কে তিনি নিয়ে যান।

তিনি জানান, “তার সুরতহাল করার পর আমরা জানতে পারি লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে না, কারণ তার বাবাও লাশের জন্য আবেদন করেছেন।”

তিনি জানান লাকিং মে ও তার ছোট ভাইয়ের একটি সন্তান হয়েছে, যার বয়স প্রায় তিন সপ্তাহ।

ওই ঘটনার পর কক্সবাজার সদর থানার এসআই আবদুল হালিম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “মেয়েটির বাবা তার জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দিয়েছেন, যা অনুযায়ী মেয়েটির বয়স ১৫ বছরের বেশি নয়। আবার তার স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকেও একটি এফিডেভিট করে বিয়ের সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে মেয়েটির বয়স বোঝা না গেলেও প্রমাণিত হয় যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।”

তবে র‍্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে হওয়ায় তার ধর্ম পরিবর্তন বা বিয়ে বৈধ নয়। বরং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করা বা বিয়েতে সহযোগিতা করাও একটি অপরাধ।

সূত্র:বিবিসি